জিলকদ–হজের প্রস্তুতির মাস

ঠিক একমাস পরেই বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহাসম্মিলন ঘটবে পূণ্যভূমি মক্কায়। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এ মহাসম্মিলন। বৈধ অর্থের মালিকগণের ওপর এ মহাসম্মিলন স্থলে উপস্থিত হওয়া ফরজ। জাবালে রহমতের পাদদেশে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে এ মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্ব মুসলিম আল্লাহর দরবারর হাজিরা জানাতে এক সুরে গেয়ে ওঠবেন-
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক;
লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক;
ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক;
লা শারিকা লাক।’

হজের এ মহা পবিত্র কর্ম সম্পাদনে রওয়ানা হওয়ার আগে হজ পালনকারীদের শারীরিক ও মানসিক বিশেষ কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। আবার এমন কিছু অভ্যাস রয়েছে যেগুলো পরিত্যাগ করাও জরুরি। হজের তালবিয়া সহিহ করে শিখে নেয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দোয়াগুলোও শিখে নেয়া জরুরী। দেশে চলছে হজে গমনেচ্ছুকদের প্রশিক্ষণ।

জিলহজের পূর্ব মাসটিই হলো জিলকদ। জিলকদ হলো আরবি চান্দ্রবছরের একাদশ মাস। জিলকদ মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জিলকদ মাসের প্রকৃত আরবি নাম হলো ‘জুলকাআদাহ’। ফারসিতে ‘জিলকাআদা’; উর্দুতে ‘জিলকাআদ’; বাংলায় ‘জিলকদ’ রূপ ধারণ করেছে। ‘জুলকাআদাহ’ বা ‘জিলকদ’ অর্থ হলো বসা বা স্থিত হওয়া, বিশ্রাম নেওয়া।

মুমিনের সওগাত অবসরে ইবাদত
জিলকদ মাস ইবাদতের ব্যস্ততার পর বিশ্রামের জন্য আল্লাহর উপহার। জিলকদ মাস হলো চার মাস ইবাদতের ক্লান্তির পর পরবর্তী দুই মাসের ইবাদতের জন্য শক্তি অর্জনের প্রস্তুতিমূলক বিশ্রাম। রমজানের পূর্ণ এক মাস ফরজ রোজা পালনের শক্তি অর্জনের জন্য যেমন আগের দুই মাসে (রজব ও শাবান) ১০টি ও ২০টি নফল রোজা এবং রমজানের ২০ রাকাত তারাবির প্রস্তুতি হিসেবে আগের দুই মাসে (রজব ও শাবান) বেশি বেশি নফল নামাজ রয়েছে।

তেমনি জিলকদ মাসের পরে জিলহজ মাসে ৯টি নফল রোজা ও নফল ইবাদত এবং তারপরের মহররম মাসে ১০টি নফল রোজা ও নফল ইবাদতের প্রস্তুতি হিসেবে জিলকদ মাসে বিশ্রামের পাশাপাশি কিছু কিছু নফল ইবাদত করা বাঞ্ছনীয় ও শ্রেয়।

হাদিস শরিফে আছে, পরকালে নেককার পরহেজগার দ্বীনদার লোকদের কোনো আক্ষেপ থাকবে না; তবে একটি বিষয়ে তাঁদের আক্ষেপ থাকবে, তা হলো যে সময়টা তাঁরা ইবাদত ছাড়া কাটিয়েছেন, সেই সময়টার বিষয়ে তাঁদের অনুশোচনা থাকবে যে কেন তাঁরা এই সময়টাও নেক আমল দ্বারা পরিপূর্ণ করলেন না।

তাহলে তাঁরা আরও বেশি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারতেন। এই একটি মাস ইবাদতে লিপ্ত হতে পারলে বছরের বারোটি মাসের মধ্যে রজব থেকে মহররম পর্যন্ত আটটি মাস একটানা ইবাদতে শামিল হয়ে যায়, যা পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখনই অবসর পাও দাঁড়িয়ে যাও, তোমার রবের ইবাদতে মশগুল হও।’ (সুরা: ইনশিরাহ, আয়াত: ৭-৮)।

পাপ পরিহারের ঐতিহাসিক মাস
ঈদুল ফিতর (রোজার ঈদ) বিগত ও ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ) সমাগত, মাঝে এই জিলকদ মাসে নির্দিষ্ট কোনো ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুআক্কাদা আমল নেই বিধায় এটি জিলকদ মাস বা বিশ্রামের মাস।
এই সময় আরবের লোকজন বাণিজ্য থেকে ফিরে আসত, যুদ্ধ থেকে ফিরে আসত, তাই এই মাস বিশ্রামের মাস।
ঋতুর পরিবর্তনে এই সময়টায় স্থানীয় আরবের লোকজনের হাতে তেমন কোনো কাজ থাকত না। আরব সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা এই মাসে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত এবং অন্যায়–অপরাধ (মদ্যপান) থেকেও নিবৃত্ত থাকত। এসব কারণেও এই মাসের নাম জিলকদ। (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর)।

ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি
রজব-শাবান মাসে নফল রোজা, রমজানজুড়ে ফরজ রোজা, সন্ধ্যা ও ভোর রাতে তারাবিহ-তাহাজ্জুদ ও সাহরি গ্রহণ এবং শাওয়ালে ৬ রোজা রাখার পর জিলকদ মাসে বিশ্রাম নিয়ে পরবর্তী মাসের রোজা ও হজ-কুরবানির প্রস্তুতি গ্রহণের মাস এটি।

জিলকদ মাসের যত আমল
এ মাসজুড়ে বিশ্রামের পাশাপাশি এ মাসেও অন্যান্য আরবি মাসগুলোর মতো নিয়মিত আমলগুলো করা যেতে পারে। তাহলো-
১. এ মাসের ১, ১০, ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখ রোজা পালন করা।
২. জিলকদ মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামের বিজের রোজা পালন করা।
৩. সোম ও বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক সুন্নাত রোজা পালন করা।
৪. কুরআন তেলাওয়াত করা ও সালাতুত তাসবিহ নামাজ আদায় করা।
৫. সম্ভব হলে ওমরাহ পালন করা।
৬. হজের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
৭. কুরবানির প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

জিলকদ মাসের স্মরণীয় ঘটনাসমূহ
১. জিলকদ মাসে যে কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহকেই নিষিদ্ধ করেছে ইসলাম।
২. এ মাসেই বাইয়াতে রেদওয়ান অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৩. ১ জিলকদ : হুদায়বিয়ার সন্ধি, হজরত আলি ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমার বিবাহ সংঘটিত হয়।
৪. ৮ জিলকদ : মুসলমানদের জন্য জীবনে একবার হজ পালন ফরজ, ইমাম দারাকিুতনি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ইন্তেকাল।
৫. ১৭ জিলকদ : খন্দকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
৬. ২৫ জিলকদ : হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম। পবিত্র কাবা শরিফ পৃথিবীতে প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয় বলে জানা যায়। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২৫ জিলকদ বিদায় হজের জন্য মদিনায় থেকে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা।
৭. ২৭ জিলকদ হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আহত হন। এই ২৭ জিলকদ উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দুই মুহাদ্দিস মুহাদ্দিস সৈয়দ আহমদ শহিদ ও ইসমাঈল শহিদ বালাকোটের যুদ্ধের ময়দানে শাহাদাতবরণ করেন। কেউ কেউ ২৪ জিলকদও বলে থাকেন।
৮. ৭ম হিজরির জিলকদ মাসে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম ওমরা পালন করেছিলেন।
৯. এ মাসেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের সব ওমরাহ পালন করেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।