জ্বলছে তামাক চুল্লি, পুড়ছে কাঠ!

পরিবেশের ক্ষতি তোয়াক্কা না করে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির প্রায় সব উপজেলায় দেদারসে জ্বলছে তামাকচুল্লি। বনাঞ্চল আর ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের কাঠ কেটে এসব চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে। তামাক চাষ বন্ধে সরকারিভাবে কোনো আইন বা নিষেধাজ্ঞা না থাকায় চলছে ধ্বংসযজ্ঞ।

তামাক চুল্লিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ধূমঘর। জমি থেকে কাঁচা তামাক পাতা সংগ্রহ করে এনে শুকানো হয় এ তামাক চুল্লিতে।

বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন হিসেবে খ্যাত তামাক এবার চাষ করা হয়েছে শতশত হেক্টর জমিতে। এ ফসল চাষ বন্ধে কোনো আইন না থাকলেও রয়েছে পরিবেশ আইন। যে আইনে প্রতিবছর হাতে গোনা কয়েকটি তামাক চুল্লিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। তবে এ ঘটনায় থামানো যায়নি তামাক চুল্লির ভয়াবহতা। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ আর জনপ্রতিনিধিদের রহস্যজনক নীবরতা। অভিযোগ রয়েছে, তামাক চাষে পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রভাবশালীদের ভয়েই মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

সরেজমিনে লংগদুর বগাচতর ইউনিয়নের রাঙ্গীপাড়া এলাকায় দেখা গেছে, ধূমঘরের অনেক দূর থেকে নাকে ভাসছে তামাক পাতা পোড়ানোর অম্লঘ্রাণ। তবে এ ঘ্রাণে কেউই আঁচ করতে পারছে না মানব শরীরের জন্য এটা কত ক্ষতিকর। আরেকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে রাঙ্গীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের অনেকটা কাছেই তামাক চুল্লিতে শুকানো হচ্ছে তামাক। চুল্লি থেকে নির্গত ঘ্রাণে কোমলমতি শিশুদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে সমস্যা হয়। কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থী জানান, অনেকেরই মাথা ঝিমঝিম করে। অনেকেই বমি করে ফেলে।

তামাক চুল্লিতে জ্বালানি কাঠ ঠেলে দেয়ার কাজ করছেন আমেনা বেগম। তবে তার মুখে নেই মাস্ক বা মুখবন্ধের ব্যবস্থা। তিনি জানান, ক্ষতি জেনেও বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয়। কারণ এখান থেকে যে আয় করি তা দিয়েই সংসার আর ঋণ শোধ করতে হয়।

একই গ্রামে রয়েছে পাশাপাশি ১০-১৫টি চুল্লি। এসব চুল্লির আশেপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সমাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেকটি চুল্লির পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে শত শত মণ কাঠ।

কাঠ সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে চুল্লির মালিক জমির কোন উত্তর না দিয়ে সরে পড়েন। পরে এলাকা ঘুরে অন্যান্য চুল্লির মালিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তারাও মুখ খোলেননি।

লংগদুর প্রায় সব ইউনিয়নের হালচিত্র এমনই। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলে তামাক পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর কাজ। উপজেলায় প্রায় চার শতাধিকের বেশি তামাক চুল্লিতে এখন পাতা শুকানোর কাজ চলছে। আর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বলছে তামাক চুল্লি, পুড়ছে কাঠ। এসব কাঠ আনা হচ্ছে পাশ্ববর্তী বনাঞ্চল এবং বাগান থেকে। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত এবং আশপাশের মানুষেরও চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে।

সচেতন নাগরিকগণ বলেন, তামাক চাষের ফলে চর্ম, ক্যান্সার এবং যক্ষার মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব রোগ দ্রুত ধরা না পড়লেও ধীরে ধীরে মানবদেহে ক্ষতি করে।

পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলেন, উপজেলায় তামাকের আবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমছে, অন্যদিকে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য বনের কাঠ আহরণের হিড়িক পড়ছে। এতে সবুজ পাহাড় ধ্বংসের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকিব ওসমান বলেন, তামাক চাষ বন্ধে সরকারিভাবে কোনো আইন না থাকায় প্রশাসন কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। তবে তামাক চাষ না করতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চাষীদের নিরুৎসাহ করে যাচ্ছে। তবে পরিবেশ আইনে তামাক চুল্লিগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু স্থানে তামাক চাষ শুরু হলেও ২০০৭ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। স্থানীয় চাষীরা অন্যান্য ফসলের চেয়ে তামাক চাষে বেশি লাভবান ও ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা থাকায় এতে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন। তবে বিকল্প কোনো ফসল পেলে ও বিক্রির নিশ্চয়তা থাকলে চাষিরা ক্ষতিকর ফসল চাষ থেকে বিরত থামবে বলে আশা পরিবেশবাদীদের।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।