দখল-দূষণে বিপন্ন কর্ণফুলী, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য

ভারতের মিজোরাম প্রদেশের লুসাই পাহাড় থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েবঙ্গোপসাগরে পড়েছে ৩২০ কিলোমিটারের কর্ণফুলী নদী। এই নদীর মোহনা-পতেঙ্গায় বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর অবস্থিত।

শিল্প প্রতিষ্ঠানের কালো বর্জ্য, নগরবাসীর ব্যবহৃত পলিথিন ও পলিমাটিতে জমা চর তিলে তিলে শেষ করছে এই নদীর জীববৈচিত্র্য। এই নদীকে ঘিরে চলছে নানা কর্মযজ্ঞ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে প্রাণ-বৈচিত্র্য হারিয়ে কর্ণফুলী শুধু মাত্র নৌ-যানই চলবে।

কর্ণফুলীর সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, নদীর দুপাড় দখল করে ইটিপি ছাড়া কারখানা স্থাপনের ফলে বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলীতে পড়ে। কমেছে কর্ণফুলী প্রশস্ততাও। আবার নগরবাসীর ব্যবহৃত পলিথিন-প্লাস্টিকের স্তর জমেছে প্রায় ২৫ ফুট। পাহাড় কাটার মাটি বৃষ্টির সঙ্গে কর্ণফুলীতে পড়ছে। ফলে ভরাট হওয়ার কারণে নদী তার স্বাভাবিক পানির ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দূষণের কারণে কর্ণফুলী নদীর ৩৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতীতে কর্ণফুলীতে ৬৬ প্রজাতির মিঠাপানির, ৫৯ প্রজাতির মিশ্র পানির এবং ১৫ প্রজাতির সামুদ্রিক পরিযায়ী মাছ পাওয়া যেত। এখন মিঠাপানির ২০-২৫ প্রজাতির এবং মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত। বিলুপ্ত হওয়া মাছের মধ্যে আছে ফাইস্যা, কাঁচকি, রূপচাঁদা, কালিচাঁদা, পাঙ্গাশ, বাচা, ভেটকি, পাশা, লইট্টা, রিকশা, মধু, পাবদা, পোয়া, মহাশোল ইত্যাদি। কমতে শুরু করেছে কাতলা, রুই, মৃগেল মাছ। হুমকিতে আছে মাছের আরও ২০ প্রজাতি।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অপরিশোধিত তরল ও কঠিন বর্জ্য নদীর পানিতে মেশার কারণে ‘ব্যাকটেরিয়া’ কর্তৃক জলজ প্রাণীর ডিকম্পোজিশন/ডাইজেশনে প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এতে পনির ডিওর (ডিসলভড অক্সিজেন) মাত্রা হ্রাস পায়। ফলে জলজ প্রাণীর অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়।’

জানা যায়, কর্ণফুলীতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রাণ ধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রয়োজন প্রতি লিটারে ৪ থেকে ৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু দূষণের শিকার এ নদীর পানিতে ডিও পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ১ থেকে ৪ মিলিগ্রাম। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য এ মাত্রা খুবই বিপজ্জনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নদীর পানিতে জীব-রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদার (বিওডি) আদর্শ মান ২ থেকে ৩ ধরা হলেও বর্তমানে তা রয়েছে প্রতি লিটারে ১০ থেকে ২৫ মিলিগ্রাম। পানির বিদ্যুৎ পরিবাহী (ইলেকট্রিক কন্ডাকটিভিটি) ক্ষমতার সহনীয় মাত্রা প্রতি সেন্টিমিটারে ৭০০ থেকে ২৮০০ মাইক্রো সিমেন্স। কিন্তু এখন রয়েছে প্রতি সেন্টিমিটারে গড়ে ৩৪০০ মাইক্রো সিমেন্স। নদীর রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদার (সিওডি) আদর্শ মান প্রতি লিটারে ২০০ মিলিগ্রাম। কিন্তু এখানে আছে এরও ওপরে।

কর্ণফুলী তার নাব্যতা, যৌবন হারানোয় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। হালদা মিলেছে কর্ণফুলী নদীতে। এখন ‘মৃতপ্রায়’ কর্ণফুলী নিজের সক্ষমতা হারিয়ে হালদাকে গিলে খাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কর্ণফুলীর নাব্যতা হারানোয় পানির ধারণ ক্ষমতা কমেছে। যার কারণে নিয়মিত জোয়ারের পানি সাগর থেকে কর্ণফুলী হয়ে হালদায় প্রবেশ করে। এতে মিঠা পানির নদী হালদা তার মূল চরিত্র হারাতে বসেছে।

কর্ণফুলী নদী থেকে মাছ আহরণের কোনো হিসাব নেই জেলা মৎস্য অফিসে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, কর্ণফুলীতে লাইটারেজ জাহাজের কারণে ওভাবে মাছ শিকার করা হয় না। আমাদের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই।

তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত, হালদার মা মাছের নিরাপত্তায় কর্ণফুলীকেও তার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। না হয় কর্ণফুলী নিজে মরার সাথে সাথে হালদায়ও বিপর্যয় ডেকে আনবে।

প্রতিবছরই ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়, এবারও হবে। নদী রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের অভিমতগুলো থাকে উপেক্ষিত। আর তিলে তিলে শেষ হচ্ছে কর্ণফুলী, হালদাসহ চট্টগ্রামের সব নদীর জীববৈচিত্র্য।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।