নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতি হুমকিতে ফেলবে শিক্ষাব্যবস্থাকে—লায়ন এম কে বাশার

‘দেশের বিদ্যালয়গুলোতে ২০২৩ সালে যে নতুন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তা শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের বিশ্ব নাগরিক গড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করতো। কিন্তু যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন (দশম শ্রেণীর) করা হবে তা শিক্ষাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

যখন অর্ধেক বিষয়ের পরীক্ষা হবে বিদ্যালয়ে আর বাকি অর্ধেক বিষয়ের ৫০ নম্বর থাকবে শিক্ষকদের হাতে তখন ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে না। যার দৃষ্টান্ত আমরা করোনার সময় দেখেছি। যখন অটোপাশ, শর্ট সিলেবাসের কথা বলা হয়েছে, পরীক্ষা পেছানো হয়েছে– শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেনি। তারা পড়াশোনা থেকে একেবারে দূরে চলে গিয়েছিলো। যা আমাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে।

আর এখন যদি নতুন এ পদ্ধতিগুলো চালু হয় তবে শিক্ষার পরিবেশ আরো খারাপ হবে। এর জন্য কিছু করার আগে নীতি নির্ধারকদের সঠিক হোমওয়ার্ক করে সামনে আগাতে হবে। তা না হলে বারবার পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের ধ্বংসের মুখে ধাবিত করবে।’

সম্প্রতি ২০২৩ সালের পরিবর্তিত শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে চট্টগ্রাম খবরের সাথে একান্ত আলাপকালে এসব কথা বলেন বিএসবি-ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার। এসময় তিনি নতুন শিক্ষাকার্যক্রমের সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে আলোকপাত করেন।

তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসছে। যেখানে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক বা নিম্ন মাধ্যমিকে কোন রকমের পাবলিক পরীক্ষা থাকছে না। যে বিষয়টি এক সময় সরকার বলেছিল কোনভাবেই সম্ভব নয়৷ তবে এখন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) দুইটি পাবলিক পরীক্ষাই বাতিল করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, নবম শ্রেণীর পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে স্ব স্ব বিদ্যালয়ে। কেবল দশম শ্রেণীতে হবে পাবলিক পরীক্ষা। সেখানেও থাকবে ব্যাপক পরিবর্তন। শিক্ষার্থীরা অভিন্ন সিলেবাসে পরীক্ষা দিবে। ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টির পরীক্ষা হবে স্কুলে আর বাকি ৫টিতে ৫০ নম্বর থাকবে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর। আর বাকি ৫০ নম্বরের ওপর অনুষ্ঠিত হবে পরীক্ষা। এছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে হবে দুটি পৃথক পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষার সমন্বয় করে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হবে।

লায়ন এম কে বাশার বলেন, দশম শ্রেণী পর্যন্ত কেবল একটিমাত্র পাবলিক পরীক্ষা থাকলে অন্যরকম জটিলতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা এতদিন পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা দিতো। তারা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলো। পরীক্ষাগুলো দিয়ে তারা সার্টিফিকেট পেতো। সমাপনীর সার্টিফিকেট ব্যবহৃত না হলেও জেএসসিটা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে কাজে আসতো।

কিন্তু এখন কেবল দশম শ্রেণীতে একটা পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানেও অর্ধেক নম্বর বিদ্যালয়ের হাতে থাকবে, শিক্ষকদের হাতে থাকবে। আর যখন বলা হবে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেলে পাশ। তখন কিছু কিছু শিক্ষক এটিকে বাণিজ্য হিসেবে বেছে নিবেন।

উন্নত বিশ্বে শ্রেণী কার্যক্রমের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে এমন প্রসঙ্গ টেনে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাধ্যমিকের আগে কোন পাবলিক পরীক্ষা নেই। সেখানে ব্যবহারিকের ওপর জোর দেওয়া হয়। আর তারা সেভাবে সফল। এর জন্য তাদের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু আমাদের কি আছে?

আমাদের বেশিরভাগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভালো করে চক-ডাস্টার ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। সেখানে ব্যবহারিকের সরঞ্জাম তো দূরের কথা! আমরা একটা শিক্ষার্থীর পেছনে মাসে ৫০ অথবা ১০০ টাকা খরচ করতেও রাজি না। যেখানে উন্নত বিশ্বে ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকা খরচ করা হয়। আমাদের ব্যবহারিক শিক্ষার সঠিক উপকরণ নেই।

শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন নয় বরং বিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি আমাদের মুক্তির উপায় হতে পারে বলে মনে করেন এই শিক্ষা উদ্যেক্তা। তিনি বলেন, বেতন বৈষম্যের জন্য বিদ্যালয়গুলো যোগ্য শিক্ষক পায় না। শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ঢেলে সাজতে হয় তবে এক্ষেত্রে কাজ করা উচিত। আমরা দেখতে পাই একই যোগ্যতা থাকা সত্বেও প্রাথমিকের শিক্ষকের চেয়ে মাধ্যমিকের শিক্ষকের বেতন বেশি। আবার অনার্স মাস্টার্স করে কেউ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে যে সুযোগ সুবিধা পান তা বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে অতি নগন্য। আর তাই যোগ্যরা শিক্ষকতা পেশা বেছে নিতে চান না। যার ফলে কাঠামো পরিবর্তন করেও শিক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল আসছে না।

তিনি আরো বলেন, নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু হবে এর জন্য যে প্রশিক্ষণ বা গাইডলাইন দেওয়ার দরকার ছিলো, কিন্তু তা হয়নি। যার ফলে শিক্ষকরা জানবেনা কিভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আর এমন পরিস্থিতিতে দেখা যাবে— যে সকল শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ছে, কোচিং করছে তাদের বেশি নম্বর দেওয়া হচ্ছে; আর যে করছে না তাকে কম নম্বর দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, কেউ হয়তো বিশেষ কিছু বই মুখস্থ করে কিছু ডাটা আয়ত্তের মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে এখন বড় আমলা হয়েছেন। উনি এখন নীতি নির্ধারণ করছেন। যখন যেটা প্রয়োজন চাপিয়ে দিচ্ছেন। যারা শিক্ষা আইন করছেন তাদের শিক্ষা নীতি জানতে হবে। যারা শিক্ষা নীতি করছেন তাদের কারিকুলাম-সিলেবাস জানতে হবে। যারা সিলেবাস প্রণয়ন করবেন তাদের বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সকল কিছু জানতে হবে। বাংলাদেশ এবং বিশ্ব কোন স্থানে আছে? কোথায় কী ধরণের জব মার্কেট তৈরি হবে, কোন ধরণের কাজ হবে— সেসব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকতে হবে। এসব কিছু মেনেই কারিকুলাম তৈরি করতে হবে।

কিন্তু যদি এমন হয় যে কারিকুলাম একজন করছেন, সিলেবাস একজন করছেন, শিক্ষা আইন একজন করছেন,শিক্ষা নীতি আরেকজন করছেন। আবার আরেকজন এসে একটা লামসাম প্রশিক্ষণ দিয়ে বলছেন আপনারা প্র্যাক্টিক্যাল ফিল্ডে নেমে যান। সুতরাং পুরোটা একটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। যার ফলে অতি মেধাবী শিক্ষার্থীরাও ধুঁকে ধুঁকে মরছে। কিছু শিক্ষার্থী এক্সট্রা ভেনিফিট নেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার আরেক শ্রেণী সকলের মাথায় ছড়ি ঘুরাচ্ছে। আর এসব যদি সমন্বয় করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।

এম কে বাশার বলেন, বৃটিশ আমল থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কেরানী ধাঁচের হয়ে গেছে। শিক্ষাটা নামে সৃজনশীল হয়েছে, কিন্তু কাজে হয়নি। কারণ আমাদের সিলেবাস, আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিটাও বলে দেয় মুখস্থ করতে হবে। সিলেবাস প্রণয়নে দক্ষ লোকদের নিয়োগ করতে হবে। ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক জব মার্কেট নিয়ে গবেষণা করছে। তারা জব মার্কেট অনুযায়ী তাদের শিক্ষাব্যবস্থা সাজাচ্ছে। আমাদেরও জব মার্কেট গবেষণা করে শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো উচিত।

এসময় তিনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গতানুগতিক বই পড়ানোর সমালোচনা করে বলেন, সেখানে আগের মতো গতানুগতিক ধারায় শিক্ষা-কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন বিষয় সামনে আসছে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আগের বিষয়গুলো পড়ানো হচ্ছে৷ আমাদের এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এসময় তিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সমাজের বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানীদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।

যা আছে ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে:
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) বাস্তবায়ন শেষে আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণী; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণী; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণীতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।

এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে এখন থেকে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। আর শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক না বাণিজ্য বিভাগে পড়বে, সেই বিভাজন হবে একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।