পরিচয় গোপন করে মিথ্যা মামলা- বাদী ও আইও’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আদেশ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী ছেনুয়ারা বেগম (২৬) পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশী যুবক মো. রায়হানের (৩৫) বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। এই ঘটনায় ৫ এপ্রিল (মঙ্গলবার) কক্সবাজার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী এক আদেশে ওই নারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন।

এবং তদন্ত না করে বাদীর পক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ও পিবিআই কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

এছাড়া অভিযোগ প্রমান না হওয়ায় মো. রায়হানকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত। রায়ের বিষয়টি আদালত সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে স্বামী পরিচয় দিয়ে মো.রায়হানের বিরুদ্ধে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যৌতুকের মামলা করেন ছেনুয়ারা বেগম। মামলাটি তদন্ত করে সত্যতা না পাওয়ায় আদালত সেটি খারিজ করে দেন। এরপর ২০২০ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালী ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়ার ছব্বির আহমদের মেয়ে লতিফা বেগম (২৭) পরিচয়ে রায়হানের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলকভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে টেকনাফ আমলি আদালতে আরেকটি মামলা করেন ওই রোহিঙ্গা নারী। ওই মামলায় আগের মামলার তথ্য গোপন করার পাশাপাশি নিজের পরিচয় সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেন তিনি। এরপর ২০২০ সালের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসআই আবু তাহের বাদীর প্রকৃত পরিচয় গোপন করে আদালতে তাঁর পক্ষে অভিযোগপত্র দেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী খালেক নেওয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, একজন রোহিঙ্গা নারী মিথ্যা তথ্য দিয়ে রায়হানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছিলেন। প্রথম মামলা খারিজ হয়ে গেলেও দ্বিতীয় মামলায় আসামি রায়হান মাস দেড়েক কারাভোগ করে জামিন নেন। দ্বিতীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বাদীর আসল পরিচয় দেননি। আজ মামলাটির চার্জ গঠনের দিন বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানায়, ৫ এপ্রিল টেকনাফ আদালতের সিআর-৪৯/২০২০ মামলার ধার্য তারিখ ছিল। এই মামলার বাদী লতিফা বেগম। আর বিবাদী রায়হান। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআই-এর এএসআই আবু তাহের।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়,বাদী লতিফা বেগম ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিচয়ে ছেনুয়ারা বেগম নাম ধারণ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে রায়হানের বিরুদ্ধে স্বামী হিসেবে যৌতুক দাবির অভিযোগে সিপি-৩৪৮/২০১৯ নং মামলা দায়ের করেন। সেটি তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে খারিজ করা হয়।

পরে একই বাদী বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয়ে লতিফা বেগম নামে মো. রায়হানের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতারণামূলকভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি চার্জ শুনানির জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু আদালতে অভিযোগ শুনানির পর্যায়ে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসামিপক্ষ বিষয়টি উপস্থাপন করেন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাজাহান এলাহি নূরী বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবির আবেদন আমলে নিয়ে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী সংশ্লিষ্ট নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চান। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাদী রোহিঙ্গা নাগরিক এবং তিনি ক্যাম্পেই বাস করে।

ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্ণিত মামলার বাদী লতিফা বেগম উক্ত শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা পরিচয়ে ছেনুয়ারা বেগম নাম ধারণ করে সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে আসছে। তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বাদীর নিয়োজিত আইনজীবী মো. হারুন অর রশিদের বক্তব্য নেন আদালত।

আইনজীবী হারুন অর রশিদ আদালতকে জানান, সিআর-৪৯/২০২০ (টেকনাফ) মামলার বাদী লতিফা বেগম এবং সিপি-৩৪৮/১৯ মামলার বাদী ছেনুয়ারা বেগম একই ব্যক্তি এবং তিনি দুটি মামলায় ভিন্ন ভিন্ন নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। পরে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বাদীকে ব্যাখ্যা প্রদান করার নির্দেশ দিলে বাদী লতিফা বেগম তার জন্ম সনদ ও তার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দাখিল করেন।

দলিলগুলো পর্যালোচনায় বাদী লতিফা বেগম বাংলাদেশী নাগরিক। কিন্তু লতিফার ভিন্ন ভিন্ন নামের কারণে কোন পরিচয় সত্য তা নির্ণয় না করে আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে বাদী লতিফা বেগমকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি এনজিও সংস্থার ভলান্টিয়ার হিসেবে কর্মরত মর্মে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেন। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে বাদীর প্রকৃত পরিচয় উদঘাটনে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবং বাদীর রোহিঙ্গা পরিচয় উদঘাটন না করে ভিন্নরূপ তদন্ত করায় এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আদেশের কপি পাঠানো হয়।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।