বঙ্গবন্ধু টানেল সড়ক—অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পায়নি সাড়ে ৪শ পরিবার

ক্ষতিপূরণ নেওয়ার সময় শেষ হচ্ছে ৩০ অক্টোবর

‘ঘর-বাড়ি বেয়াগ্নিন ভাঙ্গি ফেলাইয়ি, বাপ-দাদার ভিটামাটির ওপরে টানেলের রাস্তা অইয়ি। কিন্তু আঁরা এহনও পর্যন্ত টিয়া পয়সা ন পাই, এহন ভারা ঘরত থাহি, আজিয়ে নিজের ঘর হারাই ফেল্লি টানেলের কারণে। টেয়াল্লাই যাইলি হদে বউত অভিযোগ আছে।’ শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এমনটায় আক্ষেপ করে কথা গুলো বলছিলেন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল সড়কে অধিগ্রহণে ক্ষতিপুরণ না পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তরা।

তারা বলেন, ঘর বাড়ি সব ভেঙ্গে ফেলছে, বাপ দাদার ভিটামাটির ওপরে টানেলের সড়ক হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত টাকা পয়সা পাইনি। এখন ভাড়া বাড়িতে থাকি, দেশের স্বার্থে ভেঙে দেওয়া পৈত্রিক বাড়িঘর ছেড়ে উঠেছি ভাড়া ঘরে। নিজের ঘরের মাঝখান দিয়ে গেছে হাজার কোটি টাকার টানেল সড়ক। ধ্বংস হয়ে গেছে স্বপ্নগুলোও। কাজ শুরুর আগে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা থাকলেও এখন উদ্বোধনের বাকি এক মাস। পাইনি এখনও কোনো টাকা। অনেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে ঋণ নিয়ে চলছেন। তবে কেউ জানেন না কবে পাব সে ক্ষতিপূরণের টাকা।

শুধু তাই নয়, এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুদিরাম সিংহ, রূপন সেন মাস্টার, শিমুল সেন, কায়সার উদ্দিন, ইসমাঈল তালকুদারসহ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ পরিবারকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল সংযোগ সড়কের অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরমধ্যে আগামী ৩০ অক্টোবর (রবিবার) ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে বলে জানান টালেন কর্তৃপক্ষ। ক্ষতিগ্রস্তরা অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, টানেল প্রকল্প পরিচালক ও উপ-পরিচালক এবং জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তবে টানেল কর্তৃপক্ষের দাবী অনেকের কাগজপত্র ও দলিল নিয়ে সমস্যা থাকার কারণে ক্ষতিপূরণ নিতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্তরা।

জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মানের কারণে আনোয়ারা প্রান্তে বারশত, বৈরাগ ও চাতরী ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের অধিকাংশই তাদের ভিটা-মাটি হারিয়ে অনেকে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে অনেক পরিবার এখনো নানা জটিলতায় ক্ষতিপূরণ পায়নি। আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে টানেল। এরই মধ্যে আগামী ৩০ অক্টোবর (রোববার) ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে বলে জানান টালেন কর্তৃপক্ষ। কিন্ত নানা জটিলতায় ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের মাঝে ক্ষোভ বেড়েছে। তাদের দাবী করোনা মহামারির কারণে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যবস্থা করতে পারেনি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ মুছা তালুকদার জানান, ১৯৭৯ থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকার অধিগ্রহণ করে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে শতাধিক মানুষকে করেছে ভূমিহীন ও নিঃস্ব। তারপরও আমরা জনস্বার্থে ও দেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষসহ আমরা নিরবে সহ্য করে যাই। কিন্তু কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল সড়কের জন্য বৈরাগ, বন্দর ও বৈলচুড়া মৌজার ২১ একরের বেশি নাল, বাড়িসহ ভূমি অধিগ্রহণ করে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে থাকে। এমতাবস্থায় জনবান্ধব বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জনগণের ন্যায্য অধিকার বিবেচনা করে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের পুর্ণবাসনের অতিরিক্ত মঞ্জুরি অর্থ প্রদানের কার্য্যক্রম গ্রহণ করেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্তরা নতুন করে স্বপ্ন দেখে টাকা পাওয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিগ্রহণকৃত ভূমির অনেক মালিক দেশের বাইরে থাকা ও নাবালকদের গার্ডিয়ানশীপ নিযুক্ত সংক্রান্ত জটিলতা এবং অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা মোকাদ্দমা বিচারাধীন থাকায় সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারেনি প্রায় সাড়ে ৪শত পরিবার।

তিনি আরো জানান, এরমধ্যে আগামী ৩০ অক্টোবর (রোববার) ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে বলে জানান টালেন কর্তৃপক্ষ। আমরা ক্ষতিগ্রস্তরা অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সাংসদ ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, টানেল প্রকল্প পরিচালক ও উপ পরিচালক এবং জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছি।

বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নোয়াব আলী ও চাতরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন চৌধুরী সোহেল জানান, টানেলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সাড়ে ৪’শ পরিবার তাদের ক্ষতিপূরণ পায়নি। আগামী ৩০ আক্টোবর ক্ষতিপূরণ প্রদানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পূর্ণবাসন না করে টানেল উদ্বোধন প্রশ্ন বিদ্ধ থেকে যাবে। তাই এসব অসহায় লোকজনকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার দাবী জানাচ্ছি।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অধিগ্রহণ ও রিকুইজিশনযোগ্য মোট ৩৮২ দশমিক ১৫৫১ একর ভূমির মধ্যে ৩৬২ দশমিক ২৬৫১ একর ভূমি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অবশিষ্ট ১৯ দমমিক ৮৯ একর ভূমি অধিগ্রহণ/ হস্তান্তর কার্যক্রম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়/ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় প্রকল্পের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ১ হাজার ৬৫২ জন ক্ষতিগ্রস্থ ভূমি মালিক/ব্যক্তিকে অতিরিক্ত মঞ্জুরির অর্থ বাবদ সর্বমোট ২৬৯ দশমিক ৭১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প (প্রশাসন ও পূর্ণবাসন) উপ-পরিচালক ড. অনুপম সাহা বলেন, ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেদের সমস্যার কারণে ক্ষতিপূরণ নিতে পারছেন না। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আমাদের সব ধরণের সহযোগিতা থাকবে। ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের ৩০ অক্টোবর শেষ সময় হলেও আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ থাকবে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।