বৈশ্বিক চাকুরি বাজারকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে হবে: লায়ন এম কে বাশার

করোনায় আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও তা কিন্তু পুরো বাংলাদেশের চিত্র নয়। করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চট্টগ্রাম খবরের সাথে একান্ত আলোচনা করেন বিএসবি-ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার। আধুনিক বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের এডুকেশন সিস্টেমের তুলনামূলক চিত্রসহ অনেক বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। তিনি বৈশ্বিক চাকুরি বাজার গবেষণা করে সেই অনুযায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন।

করোনা মহামারীতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চলমান কাঠামোর বিষয়ে জানতে চাইলে লায়ন এম কে বাশার বলেন- করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে ক্ষতি কমানো যেতে পারে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নত বিশ্বের তুলনায় কম হওয়ার কারণে স্বচ্ছলরা বাধ্য হয়ে বিদেশ যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ। এভাবে বিদেশ যেতে থাকলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবীরা থাকবে না।

দেশের অন্যতম এই শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা উদ্যোক্তা লায়ন এম কে বাশার বাংলাদেশে ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক এডুকেশন ব্র্যান্ড বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রায় ৭৪ হাজার শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ প্রেরণের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। যাদের অনেকেই বিশ্বের নামকরা ক্যামব্রিজসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। করোনাকালীন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্যামব্রিয়ান কলেজসহ বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের আওতাধীন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন তথা ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছিলেন। এই বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, মহামারীতে সরকারিভাবে ‘শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ আমরা দুটোই বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারি। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে পারি। করোনায় আক্রান্তের হার কম থাকা অবস্থায় আমরা আমাদের সব প্রতিষ্ঠান ৭-১০ দিন বন্ধ রাখতে পারলে আক্রান্তের হার কম হতো। আজকে করোনার হার যে ৩০ শতাংশ তা হতো না। এখন যেটা শুরু হয়েছে, কিছুদিন পর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষনা দেওয়া এটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। আর শিক্ষার্থীরা কবে ক্লাস করবে- তা বলা যাচ্ছে না। গত দু বছর যারা করোনার কারণে অটো পাস পেয়েছে, এরা উচ্চ শিক্ষায় গেলে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

এম কে বাশার আরো বলেন- কিছুদিন আগে কলকাতা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আমাদের আরো দু সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে যা আগামী ২১ ফেব্রুয়ারিতে ধার্য করা হলেও আদৌ খুলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। এভাবে চললে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। সরকার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে পারে। আমাদের বাজেট আছে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ইন্টারনেট ফ্রি করে দিতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে মাসে খরচ হবে ৫০০ কোটি টাকা। বছরে মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। আমরা বড় বড় কোম্পানিগুলোকে আমাদের সাথে যুক্ত করে নিতে পারি। আমরা শিশু শ্রেণি থেকে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম অডিও ভিজুয়ালাইজেশন করে নিতে পারি।

এম কে বাশার বলেন, তত্ত্বীয় পাঠচক্র থেকে আমাদের বের হয়ে যেতে হবে। আমরা অ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে যেতে পারি। ২০২৫ সালের মধ্যে শিক্ষা কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। বাংলার কথা বলি, নৈতিক শিক্ষার কথা বলি, শারীরিক শিক্ষার কথা বলি- এগুলো ঐচ্ছিক করে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। কেননা এগুলো আবশ্যিক শিক্ষা। আমরা পৃথিবীর অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের আস্যাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে পারি।

তিনি আরও বলেন- বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, সেটা আমরা অনুসরণ করতে পারি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে এভাবে চললে নিকট ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। ইতোমধ্যে গত দুই বছরে আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি শিক্ষার্থী বিদেশে গেছে শিক্ষার জন্য। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানের কারণে স্বচ্ছলরা বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছে, যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ। এভাবে বিদেশ যেতে থাকলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, যারা বিদেশ যাচ্ছে তারা শিক্ষার ভালো মানের কারণে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বুয়েট বিশ্ব র‌্যাংকিং এ ৮০০-১০০০ এর মধ্যে আছে। ২০২০ সালের অটোপাস করছে। তাদেরকে ১ বছর ফাউন্ডেশন কোর্স করে তারপর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে হচ্ছে। যদি এটা আমরা করতে পারি তাহলে আমাদের শিক্ষার মান বাড়বে। এটা আগেও ছিলো। একসময়, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ হতে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসতো। আমাদের শিক্ষাকে বিশ্বমানের করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে, শিক্ষার সাথে কর্মের সম্পর্ক কী তা নির্ণয় করতে হবে। জাপান কিছু লোক নিবে। এ জন্য ১৪টা ক্যাটাগরি দেওয়া হয়েছে। ক্যাটাগরির ১টা হলো জাপানি ভাষা জানা, যদি কেউ কৃষি কাজ ভালো পারে- এটাও একটা ক্যাটাগরি। জাপানে যেতে চাওয়াদের বিশেষ বিশেষ কাজে দক্ষ হতে হবে। সেখানে তারা লাখ লাখ টাকা বেতন পাবে।

এম কে বাশার বলেন, বৃটিশ আমল থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কেরানী ধাঁচের হয়ে গেছে। শিক্ষাটা নামে সৃজনশীল হয়েছে, কিন্তু কাজে হয় নি। কারণ আমাদের সিলেবাস, আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিটাও বলে দেয় মুখস্ত করতে হবে। সিলেবাস প্রণয়নে দক্ষ লোকদের নিয়োগ করতে হবে। ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক জব মার্কেট নিয়ে গবেষনা করছে। তারা জব মার্কেট অনুযায়ী তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সাজাচ্ছে। আমাদেরও জব মার্কেট গবেষনা করে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানো উচিত।

এফএম

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।