মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়েটের দুই অমর শহীদ

আমাদের ইতিহাসের সেরা অর্জন—‘স্বাধীনতা’। এই প্রিয় স্বাধীনতা এসেছে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীনতার গৌরব এবং চেতনায় প্রতিফলিত আমাদের এই প্রিয় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ক্যাম্পাসও। এ ক্যাম্পাসও রঞ্জিত হয়েছে বীর শহীদের রক্তে। এখানে শোনা গেছে নিযার্তনের আর্তচিৎকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠান হারিয়েছে দুই তুখোড় মেধাবী ছাত্র।

শহীদ মোহাম্মদ শাহ ও শহীদ তারেক হুদা’র অজানা অধ্যায়
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও রাউজানবাসীর জন্য বিশেষ কঠিন একটি সময়। এই এক মাসেই এই দুই উপজেলাবাসী হারিয়েছিলেন তাদের হাজারো প্রিয়জনকে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বর্তমানে চুয়েট’র দুই মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ মোহাম্মদ শাহ এবং শহীদ মোহাম্মদ তারেক হুদা। যাঁদের বীরত্বগাথা হয়তো জানেন না অনেকে।

শহীদ মোহাম্মদ শাহ
শহীদ মোহাম্মদ শাহ ১৯৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ আহম্মদ সওদাগর এবং মাতা ছুরত বাহার বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ শাহ ছিলেন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর, রাঙ্গুনিয়া কলেজসহ বেশকয়েকটি জায়গাকে রীতিমতো শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। এসব স্থানে ধরে নিয়ে নিরীহ লোকজনকে কারণে অকারণে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো। যা স্থানীয় মোহাম্মদ শাহ তাঁর ভাই আহম্মদ শাহসহ স্থানীয় অনেক সাহসী যুবক মেনে নিতে পারেননি।

তাঁরা গোপনে সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর আস্তানা গুড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। যার অগ্রভাগে ছিলেন মোহাম্মদ শাহ ও তার ভাই আহম্মদ শাহ। মোহাম্মদ শাহদের চন্দ্রঘোনায় একটি নিজস্ব পেট্টোল পাম্প এবং গ্রামের বাড়িতে একটি ঔষধের দোকান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জ্বালানি ও ঔষধ সরবরাহ করা হতো। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে তারা সহায়তা করতে থাকেন গোপনে।
আর এসব খবর পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয় চিহ্নিত রাজাকার, আলবদররা। এমন খবর পেয়ে পাকিস্তানী বাহিনী এই দুই সহোদরকে খুঁজতে থাকে হন্য হয়ে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়েটের দুই অমর শহীদ 1

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীর একটি দল হানা দেয় মোহাম্মদ শাহদের গোপন আস্তানায়। তাদের কাউকে সেখানে না পেয়ে পরিবারের সব সদস্যকে ধরে রাঙ্গুনিয়া কলেজ মাঠে নিয়ে আসে পাকিস্তানী বাহিনী। এ সময় রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে অল্প দুরে ইছামতি গ্রামের ডা. কমলেন্দু বড়ুয়ার বাড়িতে পাকিস্তানী বাহিনীকে খতম করার পরিকল্পনা করছিলেন দুই ভাই এবং তাদের সহযোদ্ধারা।

এক পর্যায়ে লোক মারফত পরিবারের সবাইকে বেঁধে নিয়ে আসার খবর পান তারা। খবর পেয়ে পাগলের মতো কলেজ মাঠের দিকে ছুটতে শুরু করেন পরিবারের লোকজনকে মুক্ত করতে। পথে অনেকেই তাদের বাধা দেয়। কারণ লোকজন জানতো কলেজ মাঠে গেলেই পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্ত সব বাধা উপেক্ষা করে দুই ভাই পৌঁছে যায় কলেজ মাঠে। তাদের হাতের কাছে পেয়ে পাকিস্তানী বাহিনী পরিবারের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে তাদের বন্দী করে ফেলে।

পরদিন ১৫ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাতটার দিকে তাদের দুই ভাইকে নিয়ে যাওয়া হয় কলেজের দক্ষিনের মাজারের পাশের দিঘীর পাড়ে। সেখানেই তাদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী। গুলির আঘাতে তাদের মাথার খুলি উড়ে যায়। আর মস্তকবিহীন অবস্থাতেই তাদের দাফন করা হয়।

শহীদ তারেক হুদা
শহীদ তারেক হুদার জন্ম ১৯৪৮ সালে বরিশালের কাউখালী থানার পারসাটুরিয়া গ্রামে। বাবার নাম মোহাম্মদ শামসুল হুদা। তারেক হুদা ১৯৬৬ সালে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে এইচএসসি পাস করে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তারেক হুদা ছিলেন খুব মেধাবী, চটপটে এবং শিল্পমানসিকতা সম্পন্ন। চুয়েটের অ্যাথলেটিক্স ক্লাবের লোগো তারেক হুদার করা।

মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়েটের দুই অমর শহীদ 2

শহীদ মোহাম্মদ তারেক হুদা ছিলেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম ব্যাচের (যন্ত্রকৌশল বিভাগ) শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রকৌশল জীবনের প্রথম ধাপটি পার না হতেই দেশব্যাপী বেজে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ধামামা। প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েই তিনি চলে যান যুদ্ধে। পরে তিনি যুদ্ধে শহীদ হন।

এই দুই অমর শহীদের নামে দুটি ছাত্রাবাসের নাম করণ করেছেন চুয়েট কর্তৃপক্ষ। চুয়েট-এর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক কর্ণারে শোভা পাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়েট ক্যাম্পাসে শহীদ হওয়া দুই শিক্ষার্থী শহীদ মোহাম্মদ শাহ এবং শহীদ তারেক হুদার ছবিও। এছাড়া চুয়েটের যাবতীয় প্রকাশনাজুড়েই আছেন শহীদ মোহাম্মদ শাহ ও তারেক হুদা।

তিন শহীদের কবর
চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর গৌরবগাঁথার পাশাপাশি শহীদ অধ্যাপক দিলীপ কান্তি চৌধুরী, শহীদ মোজাফফর আহমদ এবং শহীদ মো. ইউনুছ নামের তিন শহীদের কবর ক্যাম্পাসে আছে। তাঁদেরকে হানাদার বাহিনী ইমাম গাজ্জালী কলেজের সামনে থেকে ধরে এনে ক্যাম্পাসে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। পাক আর্মি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবার ৩/৪ দিন পর ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষক কর্মচারীরা এই তিন জনের মৃতদেহ হোস্টেলের সামনে পেয়ে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।

লেখক: উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।