মিরসরাইয়ের সাংবাদিকতার ‘বাতিঘর’ নিজাম উদ্দিনের চিরবিদায়

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন চট্টগ্রামের মিরসরাই প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং স্থানীয় সাংবাদিকতার বাতিঘর নিজাম উদ্দিন। শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় হাজারো মুসল্লির অংশগ্রহণে মিরসরাই পৌরসভার নাজিরপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় জানাযার নামাজ শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে দাফন করা হয়। এর আগে তিনি গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দিল্লির আর্টেমেসি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।

মফস্বলের প্রবীণ এ সাংবাদিক ১৯৬১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন মিরসরাই পৌরসভার নাজিরপাড়া গ্রামের মোজাফ্ফর আহম্মদ সওদাগর বাড়িতে। মোজাফ্ফর আহম্মদ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তাঁর নামেই বাড়ির নামকরণ। মা আলহাজ্ব শামসুর নাহার । পারিবারিক জীবনে নিজাম উদ্দিন এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের বাবা। বড় সন্তান তানজিনা লাবিবা নিজাম ঢাকা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত। ছোট সন্তান ওয়াকিল বিন নিজাম নথ সাউথ ইউনিভার্সিটি অধ্যয়ন করছেন। সাংসারিক জীবনে মা শামসুর নাহারের পাশাপাশি স্ত্রী খালেদা বেগম লুৎফা তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলো। নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম ওয়াইজদিয় আলীয় কামিল মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করেন। পরে যাপিত জীবনে যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম এমইএস কলেজে।

১৯৮৬ সালের দিকে ছাত্র জীবনে সংবাদপত্রের তাঁর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। ওই সময় নগরীর চকবাজারে বিবরনী নামের একটি পত্রিকা স্টলে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। দেশ বিদেশের নানান কাগজ পড়তেন। পরে ১৯৮৭ সালের ২০ অক্টোবর নিজের এলাকা মিরসরাইয়ে মেসার্স সংবাদ বিতান নামের একটি পত্রিকা এজেন্ট খুলে বসেন। যা বর্তমান সময়েও তাঁর প্রধান আয়ের উৎস ছিলো।

১৯৮৮ সালে নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রামের দৈনিক নয়াবাংলা (বর্তমানে আধুনালুপ্ত) পত্রিকায় মিরসরাই সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর একে একে দৈনিক জনতা, বাংলার বাণী, দৈনিক পূর্বকোণ ও দৈনিক জনকন্ঠের মত প্রভাবশালী সব কাগজে সাংবাদিকতা করেন। তবে সবচেয়ে বেশি সময় কাজ করেন চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণে। ওই সময় তিনি পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা ইউসুপ চৌধুরী ও বার্তা সম্পাদক নাছির উদ্দিন চৌধুরীর খুব আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন ২০০২ সালের দিকে তিনি পূর্বকোণ পত্রিকা থেকে অবসর নেন। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি অসংখ্য ইতিবাচক ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখে প্রসংশিত হয়েছেন, কুড়িয়েছেন খ্যাতি।

১৯৯৩ সালে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক নূরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা ও পরামর্শে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিরসরাই প্রেস ক্লাব’। ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি সরকারি ডিক্লারেশন নিয়ে প্রকাশ করেন মিরসরাই অঞ্চলের প্রথম এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের (উপজেলা পর্যায়) দ্বিতীয় সংবাদপত্র ‘মাসিক মীরসরাই’। এরপরে ২০০৪ সালের ৭ই মার্চ সরকারি ডিক্লারেশন নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক বন্দর নগরী। এ সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে তিনি অসংখ্য সংবাদকর্মী সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। যাদের অনেকেই আজ দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রে কর্মরত রয়েছেন।

মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের হাতে সৃষ্টি মেসার্স সংবাদ বিতান, মিরসরাই প্রেসক্লাব, মাসিক মীরসরাই, সাপ্তাহিত বন্দর নগরী পত্রিকা কাল থেকে মহাকাল যাত্রা করবে বলে প্রত্যাশা সকলের।

নিজাম উদ্দিন যে সময়কালে পত্রিকা প্রকাশের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছিলেন ঠিক সে সময় (১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর) তিনি পরিবারের জ্যেষ্ঠ জনদের ইচ্ছায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। সংসার পাতেন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ন হাটের জমিদার পাড়া গ্রামের মুন্সি বাড়ির আনিসুর রহমানের মেয়ে খালেদা বেগম লুৎফার সঙ্গে। বিয়ের পরের মাসেই প্রকাশিত হয় উপজেলার সর্বপ্রথম পত্রিকা মাসিক মীরসরাইয়ের প্রথম সংখ্যা। ঐতিহাসিক ওই সংখ্যাটিতে ভুল কাটাকাটির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিলেন স্ত্রী লুৎফা।

শনিবার তাঁর শেষ বিদায়ে উপস্থিত ছিলো শত-সহস্র মানুষ। নামাজের জানাযার পূর্বে নিজাম উদ্দিনের বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর বক্তব্য রাখেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক একেএম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল আউয়াল চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী, কবি ও সাহিত্যিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাইয়ুম নিজামী, মিরসরাই পৌরসভার মেয়র মো. গিয়াস উদ্দিন, সাবেক পৌর মেয়র এম শাহজাহান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মরহুমের ছোটভাই সেলিম উদ্দিন, মিরসরাই পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাফর উদ্দিন, মিরসরাই প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শারফুদ্দীন কাশ্মীর, মিরসরাই প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেন মিঠু, চাঁদপুর রহীম নগরের পীর সাহেব মেজবাহ উদ্দিন লতিফী, মিরসরাই কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস সালাউদ্দিন লতিফী এবং মরহুমের একমাত্র ছেলে ওয়াকিল বিন নিজাম প্রমুখ।

এসময় মিরসরাই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এম আলাউদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস হোসেন আরিফ, উপজেলা বিএনপির আহবায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী, কাটাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী হুমায়ুন, ইছাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা, মঘাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসাইন মাষ্টার, মিরসরাই সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুল আলম দিদার, সাবেক চেয়ারম্যান এমরান উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কৃষকদলের সভাপতি আতিকুল ইসলাম লতিফী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহাদাত হোসেন মনসুর, সিরাজ-উদ-দৌলা, যুগ্ম সম্পাদক এম সাইফুল্লাহ দিদার, মিরসরাই সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, সূফিয়া ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ রেজাউল হক নিজামীসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।