হালদা—কর্ণফুলীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আড়াই হাজার খামার

চট্টগ্রাম নগরীর ৭০ লাখ মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা মেটাতে শহরের পাশাপাশি খরচের দিক বিবেচনায় শহরের আশপাশের উপজেলাগুলোতে গড়ে ওঠেছে প্রায় আড়াই হাজার গরুর খামার। যাতে লালন-পালন হয় দেশী, বিদেশী নানা জাতের গরু।

অল্প কিছু ক্যাটল ও ডেইরি ফার্মের বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস ও কম্পোস্ট সার তৈরির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলেও বেশীর ভাগই নজরদারির বাইরে। ফলে সংযুক্ত খাল হয়ে এসব গরুর বর্জ্য গিয়ে পড়ছে হালদা ও কর্ণফুলীতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতবেশী পরিমাণ বর্জ্য পানিতে মিশে পানির গুণগত মান নষ্ট করছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে- দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় ১২শ খামার আছে, পটিয়ায় আছে ২৫৩টি খামার, বোয়ালখালীতে ১২০টি খামার। এসব খামারের বড় একটা অংশ কর্ণফুলী নদীর সাথে সংযুক্ত খালের পাড় কিংবা আশপাশে গড়ে উঠেছে।

উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৩৮৯টি, রাউজানে আছে ৪৩৪টি খামার। যার বেশীর ভাগেরই বর্জ্য যায় সংযুক্ত খাল হয়ে হালদায়। হালদা হলো দেশের কার্প জাতীয় মাছের প্রধান প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র।

দুধের চাহিদা মেটানো ছাড়াও প্রতি বছর ঈদুল আযহায় কুরবান করার জন্য চট্টগ্রামে গরুর চাহিদা থাকে ৯ লাখ ২১ হাজার। শুধু কুরবানির জন্য জেলাজুড়ে লালন-পালন হয় ৮ লাখ ৯০ হাজার গরু। সাথে আছে কুরবান অনুপযুক্ত গরুও। আর বর্জ্যের একটা অংশ জ্বালানী, অল্প অংশ বায়োগ্যাস এবং কম্পোস্ট সার তৈরির কাজে লাগলেও বিশাল পরিমাণ বর্জ্যের গন্তব্য হালদা আর কর্ণফুলী।

হালদা—কর্ণফুলীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আড়াই হাজার খামার 1

পটিয়া উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. জপু চক্রবর্তী চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, উপজেলায় ২৫৩টি খামার রয়েছে। কার্যালয়ে আমি ছাড়া আর একজন ব্যক্তি আছেন। এতবড় উপজেলা সামলানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও জনবল সংকটে তদারকি করাটা হয়ে ওঠে না।

বোয়ালখালী উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. সেতু ভূষণ দাশ বলেন, বোয়ালখালীতে রেজিস্ট্রার্ড খামার আছে ২০টি। ব্যক্তি পর্যায়ে আরও একশ খামার আছে। এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। যে যার মতো পরিষ্কার করে।

রাউজানের উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, উপজেলায় ৪৩৪টি খামার রয়েছে। রাউজানেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। রাউজানের মতো একই অবস্থার কথা জানান হাটহাজারী উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. নাবিল ফারাবিও। হাটহাজারীতে খামার সংখ্যা ৩৮৯টি।
এই দুই উপজেলার খালগুলো সরাসরি হালদায় পড়েছে। অন্যান্য গৃহস্থালির আবর্জনার মতো খামারের বর্জ্যের গন্তব্যও হালদা।

চট্টগ্রাম জেলায় সর্বাধিক পশু খামার রয়েছে কর্ণফুলী উপজেলা। এই উপজেলায় ১২০০ খামার গড়ে উঠেছে। উপজেলার শিকলবাহা মাজার গেইট এলাকা থেকে শুরু হয়ে আলী হোসেন মার্কেট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকার খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে গরুর খামার। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ- খামারিদের পশুর বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে খালটি। কৃষকরা আগে তাদের চাষাবাদে খালের পানি ব্যবহার করতেন। এখন সেটি সম্ভব হয়না। তাদের দাবি, পশুর বর্জ্যে দূষিত হয়ে খাল-বিল ও জলাশয়কে বিষের খনিতে পরিণত করেছে। এতে চরলক্ষ্যা ও শিকলবাহা ইউনিয়নের কৃষকরা বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করতে হয়।

উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুমন তালুকদার খামারীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, প্রায় সব খামারেই সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে।

হালদা—কর্ণফুলীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আড়াই হাজার খামার 2
শিকলবাহা খালে খামারের বর্জ্য জমে স্তুপ হয়ে আছে

কিন্তু কর্ণফুলীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জেলা প্রশাসক নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশনার আলোকে গত ২০ জুন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামালের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে কর্ণফুলীর খামারগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

কর্ণফুলীর খামারগুলোতে ২৫ হাজার গরু রয়েছে। দৈনিক তিন হাজার টন গোবর এবং দুই লাখ লিটার গো-মূত্র ত্যাগের তথ্য দেয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। এর ব্যবস্থাপনার জন্য উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫টি মিনি প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাবও আলোচনা হয়েছে।

পরিবেশবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, অব্যাহত দুধ ও মাংসের চাহিদার কারণে গরুর খামার বাড়ছে। আর সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এত বিশাল পরিমাণ গবাদি পশুর বর্জ্য পানিতে মিশলে পানির গুণগত মান নষ্ট হবে। প্রশাসনকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। না হয় দুটি নদীর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। যেকোনো প্রকল্পর গ্রহণ করার আগে তিনি পরিবেশ সুরক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন। কর্ণফুলী এবং হালদার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশাল। তাই এ দুটি নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। চট্টগ্রামের এতগুলো খামারের বর্জ্য নিয়ে এর আগে চিন্তা করা হয় নাই। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তাই আমরা এই বর্জ্য যাতে নদীতে মিশে নদীর পানিকে দূষিত না করে সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।