হিমালয়ের ম্যাটাহর্ণ—আমা দাব্লামে প্রথম লাল-সবুজের কেতন ওড়ালেন চট্টগ্রামের বাবর

২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার “আমা দাব্লাম” পর্বত, যার অর্থ “মায়ের গলার হার”। এর খাড়া রিজ ও ঢালু দেয়ালের জন্য অনেকেই একে ডাকেন ‘হিমালয়ের ম্যাটাহর্ণ’ নামে। এই পর্বত এতোই সমীহের যে এর ছবি দেখা যায় নেপালের এক রুপির ব্যাংক নোটে। বাংলাদেশ থেকে ইতোপূর্বে এই পর্বত অভিযান হলেও সফলতা আসেনি। কিন্তু সেই খরা কেটেছে চট্টগ্রামের সন্তান ডা. বাবর আলীর হাত ধরে। এই পর্বত শিখরে ২৫ অক্টোবর নেপালের স্থানীয় সময় ভোর ৯.৩টায় প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে লাল-সবুজ পতাকা ওড়ালেন তরুণ পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুডিশ্বচরে এই তরুণ পেশায় একজন চিকিৎসক। নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজে তার সুনাম রয়েছে। করোনায় তার ভূমিকাও বেশ প্রশংসার ছিল। সব কিছুকে পিছনে রেখে পাহাড় প্রেমী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ডা. বাবর আলী।

২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান কার্যকরী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন বাবর। ২০১৪ সালেই ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত নেপালে এক হিমালয় অভিযানে বাবর সামিট করেন এক পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত। সেই তার হিমালয়ে পথচলা শুরু। এরপর পর্বতারোহণের বিশুদ্ধতম ধরণ বলে পরিচিত আল্পাইন স্টাইলে ২০১৬ সালে ক্লাব থেকে সামিট হয় ভারতের মাউন্ট ইয়ানাম, যা ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার কোন ২০ হাজার ফুট উচ্চতার পর্বত সামিট এবং সেই দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

পর্বতারোহণকে ধ্যানজ্ঞান মেনে তিনি বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করেন ভারতের নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে। ২০১৪ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর করেছেন এক বা একাধিক হিমালয় অভিযান। এছাড়াও নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে বাবর নিয়মিত দৌঁড়ান, করেছেন ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং, করেন কায়াকিং, পায়ে হেঁটে টানা ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন সিঙ্গেল ইজার প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেন আমা দাব্লাম।

৯ অক্টোবর বাবর অভিযানের জন্য দেশ ত্যাগ করেন নেপালের পথে। ১১ অক্টোবর প্রয়োজনীয় অনুমতি এবং অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আবহাওয়া। বৈরি আবহাওয়ার কারনে কাঠমান্ডু থেকে নিয়মিত লুকলার বিমান বন্ধ হয়ে যায় ওইসময়। কিন্তু অতোবড় স্বপ্ন চোখে নিয়ে কি বসে থাকা যায়! তাই বাবর পরদিন সড়ক পথে যাত্রা করেন বেসক্যাম্পের পথে। কিছুপথ গাড়িতে এবং বাকীপথ হেঁটে তিনি ১৯ অক্টোবর পৌঁছে যান আমা দাব্লাম বেসক্যাম্পে। বেসক্যাম্পে একদিন বিশ্রাম নিয়ে তিনি ঘুরে আসেন ক্যাম্প-১ থেকে যা উচ্চতায় স্বল্প অক্সিজেন থাকা আবহাওয়ায় শরীরকে মানিয়ে নেয়ার জন্য জরুরী।

২৩ অক্টোবর ভোরে বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে আবারো উঠেন ক্যাম্প-১ এ এবং পরদিন উঠে যান ক্যাম্প-২ এ। ২৫ অক্টোবর মধ্যরাত ১২.১৫টায় শুরু হয় তার চূড়ার লক্ষ্যে চূড়ান্ত চেষ্টা। ভোরে তিনি এই পর্বতের শীর্ষে পৌঁছে করেন বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন ইতিহাস রচনা। উড়ান লাল সবুজের কেতন।

২৬শে অক্টোবর বিকালে তিনি বেসক্যাম্পে নেমে আসেন সুস্থ অবস্থায়। পুরো পথেই তার সাথে ছিলেন তার পর্বতারোহী বন্ধু ও গাইড বীরে তামাং। ফোনে তার সাথে কথা বলে এই তথ্য নিশ্চিত করেন ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং দেশ থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার দায়িত্বে থাকা ফরহান জামান।

আমা দাব্লামে অভিজ্ঞতা নিয়ে জানতে চাইলে বাবর বলেন “এটা সত্যিকার অর্থেই পর্বতারোহীদের পর্বত”। এই অভিযান বাবর আলীর নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত এবং সার্বিক সহযোগিতায় ছিল তারই ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।