২৭ বছর পাওনাদারকে খুঁজে বাবার ঋণ শোধ করলেন ছেলে!

বাবা মারা যাওয়ার আগে কর্মকারের কাছ থেকে নেওয়া ৫ হাজার টাকা ঋণ মেটাতে বলেছিলেন ছেলেকে। পাওনাদারের নামও বলে গিয়েছিলেন তিনি। প্রয়াত বাবার সেই ঋণ মেটাতে গিয়ে অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছেন ছেলে। বাবার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী দেনা মেটাতে গিয়ে পাওনাদারকে খুঁজে বেড়ান প্রায় ২৭ বছর ধরে। অবশেষে পাওনাদারকে খুঁজে পেয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করলেন ছেলে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা এলাকায়।

বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) বিকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. মোক্তার জামানের মাধ্যমে আনোয়ারার বটতলী ইউনিয়নের রুস্তমহাট এলাকায় প্রয়াত মোহন লাল ধর কর্মকারের নাতি সুজন ধর কর্মকারকে নগদ টাকা পরিশোধ করে বাবার ঋণ মিটালেন ছেলে মো. সেলিম হক। তিনি কর্ণফুলী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক।

জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের দিকে কর্ণফুলীর বাসিন্দা ঠিকাদার ফজলুল হক একই এলাকার নয়াহাট স্বর্ণ দোকান জুয়েলার্সের মোহন লাল ধর নামে এক কর্মকারের কাছ থেকে জমির দলিল বন্ধক রেখে নেন ৫ হাজার টাকা। ঠিকাদারীতে লোকসান হওয়ায় দেওয়া হয়নি টাকাও। দিনের পর দিন সুদের এ টাকা বাড়তে থাকে আর হতাশায় ভুগতে থাকেন ঠিকাদার ফজলুল হক। আসল ও সুদের টাকা বাড়ার কারণে নিতে পারেননি বন্ধকে রাখা দলিলও। পাওয়া টাকা দেওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে বিক্রি করেন জমিও। সুদ আর আসল মিলিয়ে দশ হাজার টাকা দিতে চাইলে সুদ বেশি হওয়ায় টাকা নেননি পাওনাদার। হতাশায় ফিরে আসেন ফজলুল হক।

স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে চলছিলো তার অভাবের সংসার। এরমাঝে আক্রান্ত হন মরণব্যধি ক্যান্সারে। এর দুই বছর পরই মারা যান ঠিকাদার ফজলুল হক। মৃত্যুর আগে কর্মকারের কাছ থেকে ৫ হাজার ঋণ মেটাতে বলেছিলেন ছেলেকে। পাওনাদারের নামও বলে গিয়েছিলেন তিনি। প্রয়াত বাবার সেই ঋণ মেটাতে পাওনাদারকে খুঁজেছেন প্রায় ২৭ বছর ধরে। অবশেষে পরিশোধ করেছেন সেই ঋণ।

দাদার পাওনা টাকা ফিরে পেয়ে নাতি সুজন ধর কর্মকার বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। দাদার সঙ্গেও ব্যবসা করার সুযোগ হয়েছে। তবে দাদা কখনও বলেনি যে কর্ণফুলীর কেউ একজন থেকে তিনি টাকা পাবেন। প্রায় ২৭ বছর ধরে উনার ছেলে আমার দাদাকে খুঁজছেন কিন্তু দাদা তো মারা গেছে কয়েক বছর হচ্ছে। গত এক বছর আগে তিনি আমাদের খোঁজ পেয়েছেন, এরপর থেকে তিনি টাকা নেওয়ার জন্য এক বছর ধরে প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। বর্তমান যুগে অনেক কিছু বন্ধক দিয়েও মানুষ ফিরে নেন না এবং টাকা ধার নিয়েও দেন না। আর তিনি বাবার পাওনা টাকা দেওয়ার জন্য প্রায় পাগল হয়ে গেছে। সত্যি পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছে। আমরা প্রয়াত ফজলুল হকের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. মোক্তার জামান বলেন, সেলিম ভাই দীর্ঘদিন ধরে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন এ টাকাগুলো দেওয়ার জন্য। স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রয়াত মোহন লাল ধর কর্মকারের ওয়ারিশদের সঙ্গে কথা বলে টাকা গুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সত্যি এটা অসাধারণ একটি কাজ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম ভাইয়ের।

কর্ণফুলী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম হক জানান, বাবা মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন যেন উনার এ ঋণটা আমি পরিশোধ করি। বাবা মারা যাওয়ার পর বিপাকে পড়ে গেছিলাম মা আর বোনকে নিয়ে। সংসারের হালটা আমাকে ধরতে হয়েছিলো। এসএসসি পরীক্ষার পর টিউশনি আর চাকরি করে লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালিয়েছি। এরপর শুরু করলাম ব্যবসা। ধীরে-ধীরে ব্যবসায় উন্নতি হলে ২০১২ সালে মাকে নিয়ে হজে চলে যাই। বাবার পাওনাদারকে খুঁজে না পেয়ে এলাকার মৌলানার পরামর্শে এক ব্যক্তিকে দিয়ে বাবার বদলি হজ করাই এবং গরীবদেরকে টাকা দিয়ে দেই। তবুও মনে কেমন জানি লাগলো। যার টাকা তাকে দিতে পারলে ভালো লাগতো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম উনার বাড়ি কোথায় মা জানালো আনোয়ারার এদিকে শাহ্ মোহছেন আউলিয়া মাজার এলাকা হবে।

তিনি আরও জানান, উনার খোঁজার বিষয়ে আমাকে আনোয়ারার দলীয় রাজনৈতিক নেতাকমীরা ছাড়াও সহযোগিতা করেছেন বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। অবশেষে বটতলী এলাকায় গিয়ে সন্ধান মিলে উনার ওয়ারিশদের সঙ্গে। আমাদের এলাকায় উনাকে মনু কর্মর্কার নামে সবাই চিনতো। উনার ওয়ারিশদের উনার নাম বললে তারা চিনেন না বলে জবাব দিয়ে দেন এবং টাকা নিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে পড়ি আরেক বিপাকে। অবশেষে তাদের পূর্ব পুরুষের সঙ্গে কথা বলে সনাক্ত করি এ মনু কর্মকারই মোহন লাল ধর কর্মকার। প্রায় ২৭ বছর পর বাবার পাওনা টাকা দিতে পেরে অনেক খুশি হচ্ছে। বাবার একটু ঋণ শোধ করতে পেলে নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী মনে হচ্ছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।