অতিথিদের ১ ঘন্টা বসিয়ে রেখে মেয়র বললেন—চট্টগ্রামের স্বার্থে ইগো ছাড়তে হবে

চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ এবং ইগো ছাড়তে হবে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। চসিক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসমেক’র যৌথউদ্যাগে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যা নিরসন, পর্যটন শিল্প গড়ে তোলাসহ মহানগরের সৌন্দর্যবর্ধন শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি।
রোববার (১৫ অক্টোবর) টাইগারপাসস্থ চসিক কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অনুষ্ঠানে চসিকের কর্মকর্তারা ছাড়াও বিদেশী একাধিক অতিথি, আইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বর্তমান ও সাবেক অন্তত চারজন চেয়ারম্যান, ওয়াসা চেয়ারম্যান, চেম্বার সভাপতিসহ গ্রুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ অংশ নিয়েছে। মেয়র যথারীতি দেরীতে উপস্থিত হচ্ছেন দেখে এক পর্যায়ে দুপুর ১২টার পর অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। পরে ১২.৩৩টায় মেয়র অনুষ্ঠানে যোগ দেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, এটি ছিল মেয়রের দিনের প্রথম কর্মসূচি। একঘন্টা দেরীতে যোগ দিয়েছেন সরাসরি বাসা থেকেই।
গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের বসিয়ে রাখার বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গুঞ্জন ছিল। উপস্থিত এক প্রকৌশলী চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, আমরা যারা বিভিন্ন দপ্তর থেকে এখানে এসেছি তাদের জন্য বিষয়টি দৃষ্টিকটু। শুধু চসিকের কর্মসূচি হলে তাদের কর্মকর্তারা দেরী হোক বা না হোক সারা যেতো। এখান থেকে নিজ দপ্তরে গিয়ে নিজের কাজও করতে হবে, এই অনুষ্ঠানের ফলোআপও করতে হবে। সঙ্গত কারণেই এখানে বসে থাকারা প্রভাব আমাদের সবার কাজে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেকগুলো ভিডিও কনফারেন্সে আমি অফিসের পক্ষে অংশ নিয়েছে। তাঁকে কখনো ১ মিনিটও দেরী করতে দেখিনি—সেটা সকাল ৯টায় হোক কিংবা দিনের যে কোনো সময় হোক।

এসমেক বাংলাদেশ এর আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ এ সবুর বলেন, নগরীকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। তার উপস্থাপিত পরিকল্পনায় ফিরিঙ্গি বাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পার্ক ও ইকো পার্ক, নদীর তীরে পর্যটন সুবিধাদি নির্মাণ, নাইট মার্কেট, চট্টগ্রাম আই, ক্যাবল কার, ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ইত্যাদির মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরকে একটি দৃষ্টনন্দন, ঝলমলে শহরে পরিণত করার চিত্র উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানের ৪-৫টি মেগা মল নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে একটি আন্তর্জাতিক মানের শহরে রূপান্তরিত করা যায়। আগ্রাবাদ ডেবা সহ শহরের সমস্ত প্রধান জলাশয়কে সবুজ, পার্ক, ওয়াকওয়ে, ওয়াটার ফ্রন্ট ডাইনিং পানির ফোয়ারা ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দর করা যায়। চট্টগ্রাম মহানগরের খালগুলোকে যাত্রী-মালবাহী নৌকার চলাচলের জন্য শহরের মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার খাল সংস্কার ও এর ব্যবহারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। খালের উভয় পাশে সাইকেল রাস্তা, হাঁটার রাস্তা সবুজায়ন পরিষেবা এবং শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করা সময়ের দাবি। বাটালি হিল ও সিআরবি মধ্যে ইকোব্রিজ র্নিমাণ। রাস্তায় পেইডপাক, কারর্পাক, বিল্ডিং নির্মাণ এবং নিদিষ্ট স্থানে পার্কিং করার জন্য স্থান নিধারণ করে দেয়া জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দান জরুরি। নগরীর ট্রাফিক ও নির্বিঘ্নে পরিবহণ চলাচলের বিষয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থায় প্রয়েজনী শৃঙ্খলা আনতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা অতিব জরুরী।
শহরের জন্য মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের জন্য একটি নিদিষ্ট ট্রাফিক মডেলের উপর ভিত্তি করে পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাাপনা পরিকল্পনা সহ একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান তৈরির করা দরকার। মাস্টার প্ল্যানে কিছু প্রকল্প বিবেচনা করার প্রস্তাব দেন যার মধ্যে রেলস্টেশন ও বাস স্টেশন শহরের বহিসীমানায় স্থানান্তর করা এবং মেট্রো, বাস ও ট্যাক্সির রেলওয়ের স্টেশন সাথে সংযুক্ত করা যায়। তিনি শহরের জলাবদ্ধতার বিষয়ে মাইক ১১, মাইক আরবান এবং মাইক ২১ মডেল পুনঃস্থাপন করে এর প্রয়োগে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান আপডেট করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।

প্রকৌশলী সবুরের উপস্থাপনার শেষে চসিক মেয়র বলেন—চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে আমি সবার কাছে যাই, ইগো দেখাই না। চট্টগ্রামকে নান্দনিক নগরী গড়তে আমি রেলওয়ে, সিডিএসহ সবগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করেছি। কাতালগঞ্জে গণপূর্তের একটি পতিত ভূমি ছিল যেখানে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধের আখড়া ছিল। গণপূর্ত আমাকে ভূমিটি দিয়েছে, সেখানে আমরা ওয়াকওয়ে, ব্যয়ামাগারসহ সৌন্দর্যবর্ধন করে দিয়েছি। এছাড়া সামুদ্রিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগাতে ওশান এমিউজম্যান্ট পার্ক গড়ার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রস্তাবটি পাঠানোর পর মন্ত্রণালয়ে এনকোয়ারি দিয়েছে। দ্রুতই এটি বাস্তবায়নে কাজ শুরু হবে বলে আশা করি।
“বর্তমানে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠের খুব অভাব এজন্য চান্দগাঁয়ে স্পোর্টজোন গড়ার পাশাপাশি প্রত্যেক ওয়ার্ডে পতিত ভূমিতে খেলার মাঠ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছি। বাটালিহিলে চট্টগ্রাম ওয়াচ টাওয়ার করার প্রস্তাব ঢাকায় পাঠিয়েছি। রেলমন্ত্রীর সাথে দেখা করে জানিয়েছি জোড়ঢেবা, ইউরোপিয়ান ক্লাবসহ রেলের অধীনে অনেকগুলো ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ওয়াটার বডি রয়েছে। আমি বলেছি চসিকের মালিকানার দরকার নাই, আপনারা আমাকে ভূমি দিন চসিকের নিজস্ব অর্থায়নে সেখানে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে দিব।”

সড়ক যোগাযোগকে নিরাপদ করার উদ্যোগ নিয়ে মেয়র বলেন, নগরীতে ৩৮টা ফুটওভার ব্রিজ করা হবে। ট্রাফিক বিভাগের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ নেয়া হবে যাতে ফুটওভার ব্রিজগুলো সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা দেয়। যানজট কমাতে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ঠেকাতে পে-পার্কিং চালু করা হবে। অনেকগুলো বহুতল বাড়ি ও মার্কেটে পার্কিং এর ব্যবস্থা নেই, এ পরিস্থিতি নিরসণে জরিমানা করতে হবে।

এসমেক এর ডিরেক্টর অব আর্কিটেকচার মিঃ আনন্দ এস লোরেম্বাম, (বি আর্চ) শহরের সৌন্দর্যবর্ধন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এসমেকের প্রধান ডিজাইনার, পরিবহন বিভাগ সুজয় সুজাতারন, চট্টগ্রাম মহানগরের ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। চট্টগ্রাম ওয়াসার ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ সিভিক সেন্স বৃদ্ধির জন্য স্কুল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালুর পরামর্শ দেন। চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম নগরীতে চসিকের চলমান উন্নয়নযজ্ঞ তুলে ধরেন।

বক্তব্য রাখেন আইইবি চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন, আইইবি চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদ, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ, রেলওয়ে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের এস্টেট অফিসার সুজন চৌধুরী, এলজিইডি’র সুপারিন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহবুব হোসেন, সিডিএ’র মাস্টার প্ল্যান পরামর্শক মো. নুরুল হাসান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ এর অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কৃত্তিমান চাকমা।
উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, মেয়রের একান্ত সহকারী আবুল হাশেম, কাউন্সিলরবৃন্দ, বিভাগীয় সভাপতিবৃন্দসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন এসমেক বাংলাদেশের এর নির্বাহী পরিচালক ড. জনার্দন সুন্দরম।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।