অন্যের বুক খালি করে নিজের মাতৃত্বের দুঃখ ঘোচাতে গিয়ে ধরা খেলেন নাসিমা

ফেনী পরশুরামের গৃহবধু নাসিমা আক্তার। তার কোল জুড়ে এক সঙ্গে আসে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে শিশু। যমজ সন্তানের জন্ম দেয়া নাসিমার বুক খালি করে ছেলে শিশুটি পাড়ি জমায় পরপারে। মেয়ে শিশুটি ছটফট করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনআইসিইউতে। এতটুকুতে নাসিমা আক্তারের জন্য যে কারোই মন কাঁদবে। কিন্তু সেই নাসিমা নিজের বাচ্চাকে হাসপাতালে রেখে আরেকজনের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। পরে পুলিশ গিয়ে ফেনীর পরশুরামের গ্রামের বাড়ি থেকে সেই বাচ্চা উদ্ধার করে হাসি ফোটালেন বাচ্চার পিতা-মাতার মুখে।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় পাঁচলাইশ থানায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিশুটিকে চুরি, এরপর উদ্ধারের পুরো ঘটনা তুলে ধরেছেন সিএমপির পাঁচলাইশ জোনের সহকারী কমিশনার আরিফ হোসেন। এসময় পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা, পরিদর্শক (তদন্ত) আখতার হোসেন, চমেক পুলিশ ফাঁডির আইসি নুরুল আলম আশেক উপস্থিত ছিলেন।

সিএমপির পাঁচলাইশ জোনের সহকারী কমিশনার আরিফ হোসেন বলেন, লোহাগাড়ার আধুনগরের বাসিন্দা আবু মোহাম্মদ নোমানের স্ত্রী আসমা উল হোসনা গত ১৫ ডিসেম্বর জিইসি এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু আসমা ও তার সন্তানের শারীরিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকেরা চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী ১৭ ডিসেম্বর চমেক হাসপাতালে মা-মেয়েকে নিয়ে যান স্বজনেরা। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে মাকে এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ভর্তি করানো হয় বাচ্চাটিকে। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এনআইসিইউতে স্বজনদের প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সময়ে রোগীর কিছু প্রয়োজন হলে হাসপাতালের কর্মরত নার্স-আয়ারা স্বজনদের গেটে এসে বলেন। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায় শিশুটির মা ও দাদি এনআইসিইউর ৩১ নম্বর বেডে বাচ্চাটিকে রেখে গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার খোঁজ নিতে ভেতরে যেতে চাইলে শিশুটির দাদি-নানিকে ভালো আছেন বলে নিশ্চিত করেন কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী। কিন্তু একইদিন দুপুর ২টায় শিশুটির খালা এনআইসিইউর ভিতরে গেলে দেখেন তার ভাগ্নি ৩১ নম্বর বেডে নেই। তখন শিশুটির স্বজনেরা ঘটনাটি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, নিরাপত্তারক্ষীদের জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়ার্ডে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও না পেয়ে শিশুটির বাবা পুলিশের দ্বারস্থ হন। পাশাপাশি এই ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পুলিশের সহযোগিতা চায়।

ওসি পাঁচলাইশ সন্তোষ চাকমা বলেন, পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কিন্তু হাসপাতালে অনেক ভিড় থাকায় ভিডিও থেকে তেমন কিছু বের করা সম্ভব হয়নি। এরপর আরও তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, এনআইসিইউতে আরেকটি অসুস্থ বাচ্চা ভর্তি থাকলেও তার কোনো অভিভাবক সেখানে নেই। সেই অভিভাবকটি সকালেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন। পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তালিকা পর্যালোচনা করে নাসিমা আক্তারের মোবাইল নম্বর খুঁজে পাই। তার নম্বরই খুলে দেয় রহস্যের জট। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নম্বরটি ট্র্যাকিং করে ফেনীর পরশুরাম থেকে তাকে আমরা গ্রেপ্তার করি।

তিনি আরও বলেন, নাসিমা আক্তার প্রথমে বলছে ভুলে বাচ্চাটি নিয়ে গেছে। কিন্তু নিজের বাচ্চা আর চুরি করা বাচ্চার গায়ের রঙ, শরীরের গড়ন অনেক পার্থক্য বলার পর চুরির বিষয়টি স্বীকার করেছে। নাসিমা আক্তারের পাশাপাশি তার মা খারু আক্তারকেও আটক করা হয়েছে।

চুরি হওয়া বাচ্চাটি ছিল পেশায় মুদি দোকানি লোহাগাড়ার আবু মোহাম্মদ নোমানের। পাঁচলাইশ থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, মেয়েটি আমাদের প্রথম সন্তান। ওকে ঘিরে আমাদের বহুদিনের আশা-ভরসা, স্বপ্ন। আল্লাহর অশেষ রহমত যে পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে আমরা মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। তাকে হারানোর পর মনে হয়েছিল পুরো পৃথিবীটাই শেষ হয়ে গেল। আমাদের মরে যাওয়াই ভালো। এখন যেন আমি ও আমার স্ত্রী নতুন জীবন পেলাম। মেয়েকে আর চোখের সামনে থেকে সরতে দেবো না।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।