ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ: চবি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক ভাবনা

আধুনিক প্রযুক্তির এই বিজ্ঞানের যুগে মানুষ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে মাসের দূরত্ব দিনে কমে এসেছে, দিনের দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে ঘন্টায়। কারণে-অকারণে বড্ড কল্যাণের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই সময়ে-অসময়ে কখনও আবার হয়ে ওঠে ভয়ংকর, দুর্বিষহ। গাড়ি চালকদের অতৎপরতা, ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ আর যাত্রীদের অসাবধানতায় প্রতিনিয়তই সড়ক-মহাসড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রযুক্তির সহযোগিতায় জীবন সহজ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ক্রমেই মানুষের জীবন হয়ে ওঠছে আরও অনিরাপদ। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনার কারণ এবং তার সমাধান নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাফছান।

প্রকৌশলগত ত্রুটি অপসারণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি

মোহাম্মদ মারুফ মজুমদার: সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রকৌশলগত ত্রুটি ও সড়ক আইন প্রয়োগে কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাঁক চিহ্নিত করতে ব্যর্থতা, সাইন-সিগন্যাল ও রোড মার্কিংয়ের স্থাপনাগত সমস্যা এবং বাস-বে নির্মাণ করতে না পারায় সড়কগুলোতে প্রায়শই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো, সড়ক-মহাসড়কে নিত্যনৈমিত্তিক বিশৃঙ্খলা, যানজট, গাড়ি চালকের বেপরোয়া গতি এবং সড়ক ও পরিবহন খাতে ঘটা সহস্র অনিয়ম আর আইনের অপপ্রয়োগের ফলে ক্রমশ উর্ধ্বগামি নিত্য সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তাজা প্রাণের সংখ্যা। এমতাবস্থায়, সড়ক ব্যবস্থার প্রকৌশলগত ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে সরকারি ও বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করলে অচিরেই পরিবহন খাতে দুর্ঘটনার মাত্রা কমে আসবে। 

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা জরুরি

নাসরিন সুলতানা হিরা স্বাভাবিক জীবনযাপনের সার্বক্ষণিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এর তথ্যমতে, গত দুই দশকে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৯৮৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর পিছনে দায়ী অপ্রশস্ত ও ভাঙা রাস্তা, অতিরিক্ত যানবাহন, ত্রুটিপূর্ণ ইন্জিন, চালকের অমনোযোগীতা, অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানোসহ আরও বিভিন্ন কারণ। এসডিজিতে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত যানবাহন সম্প্রসারণ করে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সুলভ পরিবহণ ব্যবস্থায় সব নাগরিকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বিশেজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাফিক আইনের আধুনিকীকরণ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এই ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা থেকে দেশের মানুষ রক্ষা পাবে।

নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে আমাদের করণীয়সমূহ

আজিজুল হক রাহী: বর্তমানে দেশে সড়ক পথে দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে যানবাহনের অত্যাধিক গতি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন, ট্রাফিক আইনের অবমাননা, পথচারীদের অসতর্কতার সাথে সড়ক পারাপার এবং সড়কের কাঠামোগত সংকীর্ণতা ইত্যাদি। তাই,  নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণের জন্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে, পরিবর্তন করতে হবে গাড়ি চালকদের প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জনসাধারণ ও গাড়ি চালকদের সচেতন করতে হবে। সড়ক -মহাসড়কে পথচারীদের সহজেই যাতায়াত  করার জন্যে স্বল্প খরচে জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারব্রিজ নিমার্ণ এবং সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উপর্যুক্ত পদক্ষেপসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

দুর্ঘটনা এড়াতে নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে

নূসরাত জাহান ঐশী: “ঈদ মানে আনন্দ” – কিন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথাটি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। এর কারণ ঈদ যাত্রায় মাত্রাতিরিক্ত ভোগান্তি ও ক্রমবর্ধমান সড়ক সড়ক দুর্ঘটনা।  সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কেবল বেপরোয়া ও মাদকাসক্ত গাড়িচালক, ওভারটেকিং, লাইন্সেন্সবিহীন অদক্ষ ড্রাইভার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, রাস্তাঘাটের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর দ্বায় চাপালে চলবে না, পথচারী ও যাত্রীদের অসাবধানতায়ও অনেকসময় সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০২২ সালে সংগঠিত ৬৭৪৯টি সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৯৯৫১ জন মানুষ, আহত হয়েছেন আরও ১২৩৫৬ জন, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও নৌপথ, রেলপথেও দূর্ঘটনাও বাড়ছ প্রতিনিয়ত। কেবল সরকার কিংবা একটা নির্দিষ্ট মহলের পক্ষে এককভাবে সড়ক দূর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়, তাই দুর্ঘটনা এড়াতে নিজ নিজ জায়গা থেকে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। 

সর্বসাধারণের সচেতনতায় কমবে সড়ক দুর্ঘটনা

প্রত্যুৎ দেবনাথ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিশ্বব্যাংক এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট যানবাহনের ০.৫% বাংলাদেশে থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার জন মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। সড়কগুলোতে ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনায় হাজারও মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি প্রতিবছর জিডিপির ২-৩% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার একটি প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণ এবং গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডব্রেকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি, সর্বসাধারণের সচেতনতা এই অভিশাপের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে। ২০১৭ সালে ঘোষিত নিরাপদ সড়ক দিবসকে (২২ অক্টোবর) ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই  থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত সচেতন মানসিকতার স্ফুলিঙ্গ’ই পারে সড়ক দুর্ঘটনার কড়ালগ্রাস থেকে আমাদের বাঁচাতে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।