এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন ‘ঝর্ণার শহর’ মিরসরাই

মিরসরাই—চট্টগ্রামের প্রবেশ পথে পাহাড় আর সমুদ্রে বেষ্টিত এক নগর। যেখানে একদিকে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে পহাড় ও পাহাড়ি ঝর্ণা অন্যদিকে সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই এলাকার ঝর্ণা, লেক ও নদীর সাথে কৃত্রিমভাবেও গড়ে ওঠেছে কিছু পর্যটন কেন্দ্র। এই ঈদে পরিবার পরিজনকে সাথে নিয়ে চাইলেই এসব স্থান ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য লাভ করা সম্ভব। চলুন জেনে নেয়া যাক মিরসরাইয়ের কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

মহামায়া লেক, এ যেন সুনিপুণ শিল্পীর কারুকাজ

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 1
মহামায়া লেক

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্তিম লেক মহামায়া লেক। এটি চট্রগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় অবস্থিত। উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘী বাজার থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোলে ১১ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে মহামায়া লেক গড়ে উঠেছে।

আঁকা বাকা জলপথ ও পাহাড়ের মিতালী ছাড়াও এখানে পাহাড়ি গুহা, রাবার ড্যাম ও অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে। এখানকার পাহাড়ী প্রকৃতি সত্যি অনিন্দ। এখানকার সু্বিশাল পাহাড়ী প্রকৃতিতে রয়েছে হরেক রকমের গাছ-গাছালি। মহামায়া লেকে আছে কায়াকিং ও তাবুতে রাতে ক্যাম্পিং করার সুবিধা।

আর এইসব কিছুর জন্য দেশের বিভিন্নস্থানের পর্যটকদের আগ্রহের স্থান এটি। পর্যটন কেন্দ্রটি দেখতে প্রায় প্রত্যেকদিন জনসমুদ্রে পরিণত হতো মহাময়া লেক । শিশু, বৃদ্ধা, শিক্ষার্থী কিংবা কর্মজীবী সবার নজরে মিরসরাই এই স্থানটি ।

২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামায়া সেচ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত মহামায়া লেকের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ি ঝরনা। স্বচ্ছ পানির জলাধারের চার পাশ সবুজ চাদরে মোড়া। মনে হয়, কোনো সুনিপুণ শিল্পীর কারুকাজ।

খৈয়াছড়া ঝরণা: সৌন্দর্য যেখানে ডেকে পাঠায়

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 2
খৈইয়াছড়া ঝর্ণা

নিঝুম পাহাড়ী প্রকৃতির ঘুম ভাঙ্গিয়ে অবিরত ছুঁটে চলে ঝরণা। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে ছন্দে আনন্দে আঁকাবাকা পথে গড়িয়ে যায় জল। আর এই ঝরণা সৃষ্টি করে মন ভোলানো সৌন্দর্য। যা আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাসুদের।

এমনি এক অনিন্দ্য সৌন্দর্যের ঝরণা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত খৈয়াছড়া ঝরণা। সবুজ বনবৃক্ষে আচ্ছাদিত পাহাড়ের গভীরে এই ঝরণা। যেমন সুন্দর এই ঝরণা তেমনি এর চারপাশের প্রকৃতি।

উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পার্শ্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ৪.২ কি.মি পূর্বে এই ঝর্ণা অবস্থিত। ধারণা করা হয় অনেক বছর আগে থেকে নির্জন পাহাড়ে নিরবে বয়ে চলেছে এই ঝরণা। তবে সবুজ বৃক্ষ,গুল্ম,বনলতার আড়ালে এটি অবিষ্কার হতে সময় লেগেছে প্রায় ৫০ বছরের মতো । আবার অনেকে মনে করছেন পাহাড়ী ঢলের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই ঝরণা।

২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে বড়তাকিয়া ব্লকের প্রায় ২৯৩৪ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করায় খৈয়াছড়া ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের রামগড়-সীতাকুন্ড- রিজার্ভ ফরেস্টের খৈয়াছড়া ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো খৈয়াছড়া ঝর্ণার সংরক্ষণ।

খৈয়াছড়া ঝর্ণায় মোট ৯টি বড় ঝর্ণার ধাপ রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ। মূল সড়ক থেকে এই ঝরণায় যেতে হলে কিছুটা পথ সিএনজিতে করে যেতে হয়। বাকিটুকু পাহাড়ী উচুঁ নিচু পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়।

যেতে যেতে উপভোগ করা যায় মনভোলানো সবুজের সমারোহ। গুল্মলতায় ঘিরে রেখেছে চারপাশ। মাঝে মাঝে দেখা যায় পাহাড়ী ফুল। আর একাধারে পাখির গান যেন পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানিয়ে যাচ্ছে।

একটু পথ পাড়ি দিলে দেখা যাবে ছোট খাল। ঘাষ আর নুড়ি পাথরে ভর্তি এই খাল। এই পথ দিয়েই ঝরণার পানি পতিত হয়। মাঝে মাঝে বড় পাথরও রয়েছে। আবার ঝরণার পানিতে ডুবে অনেক পাথর হয়েছে মসৃণ। এই পাথরে একটু বসে চলতি পথের ক্লান্তি দূর করা যায়।

এভাবে হাটতে হাটতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাটলেই যাওয়া যাবে এই ঝর্ণার নিচের ধাপে। এর উপরে ধাপে ধাপে রয়েছে অন্যসব ঝর্ণা। প্রত্যেক স্তরই অপরূপ সুন্দর। উপরের পাহাড়ী প্রকৃতি থেকে নেমে আসছে সুপ্ত জলরাশি। আর এই জলে শরীর ভিজিয়ে অনন্দে মেতে উঠে পর্যটকরা। কেউবা ছবি তুলে, কেউবা ঝর্ণায় গোসল করে। আবার কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এই সৃষ্টির রহস্য।

বোয়ালিয়া ট্রেইল: এক রুটে ৩ ঝর্ণা

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 3
বোয়ালিয়া ট্রেইল

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ এখন বোয়ালিয়া ট্রেইল। ঝর্ণা, খুম, ক্যাসকেড, ঝিরি পথ এই ট্রেইলটিকে করেছে বহুগুন দর্শনীয় । এই এক রুটেই আপনি দেখা পাবেন ৩টি ঝর্ণার।

বোয়ালিয়া ট্রেইলে আছে বোয়াইল্যা, বাউশ্যা, অমরমানিক্য ঝর্ণা। এছাড়া আছে ন হাইত্যে কুম, পালাকাটা খুম, উঠান ঢাল, আন্দারমানিক ঝর্ণা, তিন নং ছড়া, কলাতলি ঝর্ণা, লতকাও বা কেম্বাতলী ঝর্ণা এবং লতা বায়ানী।

দুই দিকে উঁচু পাহাড় আর মাঝখানে গিরিপথ, পাথুরে দুর্গম ঝিরি-যার দু পাশে গহীন জঙ্গল বোয়ালিয়া ট্রেইলকে করেছে এডভেঞ্চারাস । ঝর্ণার পানিতে পাহাড়ে তৈরি হয় নতুন পরিবেশ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বেড়ে উঠা ঝর্ণাগুলো তখন ফিরে যায় যৌবনে। ঝর্ণার শো শো শব্দে প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠে নিমিষেই। তার পাশাপাশি রয়েছে ট্র্যাকিং পথ ও পর্যটকদের অনেক আকর্ষণ করার বিষয়।

আর এখানে এডভেঞ্চারের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে ঝর্ণার শীতল জলের ছোঁয়া পাওয়ার আনন্দ অন্যরকম।

নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা: এ এক অপরূপ দৃশ্য

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 4
নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা

মিরসরাইয়ে পাহাড়ে অবস্থিত আরেক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা। ঝর্ণায় প্রবেশে যে ঝিরিপথ আছে তা নাপিত্তাছড়া ট্রেইল নামে পরিচিত। এই ট্রেইলে আছে টিপরা খুম, কুপিটা খুম, বাঘবিয়ানী ঝর্না ও বান্দরখুম নামের আরও বেশ কিছু ঝর্ণা ও খুম। তুলনামূলক সহজ ট্রেইল হওয়ায় একটু কষ্ট করলে একদিনেই পুরো ট্রেইল হেঁটে উপভোগ করতে পারবেন।

উপজেলার নয়দুয়ারী বাজার থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা রেল লাইন পার হয়ে আরও কিছুদূর হেঁটে গেলে নাপিত্তাছড়া পাড়ার দেখা পাবেন। সেখান থেকে থেকে ঝিরি ও পাহাড়ি পথের ট্রেকিং শুরু হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথমে এই ট্রেইলের টিপরা খুমের দেখা পাবেন। মূলত এটি একটি ক্যাসকেড। টিপরা খুমের উপরেই কুপিকাটা খুম। এই খুম বেশ গভীর।

কুপিকাটা খুমের ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে আবার ঝিরিতে নেমে সামনে গেলে হাতের বামে আরও একটি ঝিরি পড়বে। এই ঝিরি ধরে ৩০ মিনিটের মত গেলে ঝিরির শেষ মাথায় বাঘ বিয়ানী ঝর্ণা দেখতে পাবেন। সেই ঝর্ণা দেখে আবার পিছনে এসে আগের ঝিরি ধরে সামনের এগিয়ে গেলে কিছু সুন্দর ক্যাসকেড পাবেন আর ঝিরির শেষে দেখা পাবেন বান্দর খুম ঝর্ণার।

বাওয়াছড়া লেক: পানির সাথে মিলবে পাখপাখালির শব্দ

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 5
বোয়ালিয়া লেক

বাওয়াছড়া লেক। ঝর্ণার পানির কলকল ধ্বনি, সবুজ গাছের ব্যষ্টনি। অতিথি পাখিদের আগমন। মিরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ছোটকমলদহ বাজারের দক্ষিণ পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেড় কিলোমিটার পূর্বে বাওয়াছড়া লেকটির অবস্থান। বাওয়াছড়া লেকটি মিরসরাই এর ওয়াহেদপুর গ্রামের বারমাসি ছড়ার মুখে অবস্থিত বলে লেকটির নামকরণ করা হয়েছে বাওয়াছড়া লেক।

বাওয়াছড়া লেকের মূল আকর্ষণ এখানে অনেক জীব বৈচিত্রের এক মিলন মেলা। লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল। একটি ঝিরিপথ। চলার পথে শোনা যায় হরিণের ডাক। পাখিদের ডাক। বাওয়াছড়া লেকের ঝর্ণার পানিতে গোসল করতে যেন বাধ্য করবে।

কেউ কেউ রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাওয়াছড়া পাহাড়ের পাদদেশে ক্যাম্পিং করে অবস্থান করছেন। জ্যোৎস্না রাতের রূপালী আভার সাথে ঝর্ণার নূপুর ধ্বনি শুনতেই ছুটে আসেন তারা।

মুহুরী সেচ প্রকল্প: জলের সাথে সূর্যও হাসে

এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন 'ঝর্ণার শহর' মিরসরাই 6
মুহুরি সেচ প্রকল্প

চট্টগ্রাম জেলার প্রবেশ পথের এই উপজেলায় নিকটেই রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরী প্রজেক্ট। তবে এটির বেশিরভাগই পড়েছে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায়। ফেনী সদর হতে সোনাগাজী উপজেলা পর্যন্ত দূরত্ব ২০ কি.মি. এবং সোনাগাজী উপজেলা হতে এর দূরত্ব ২০কি.মি.। অর্থাৎ ফেনী সদর হতে মুহুরী প্রকল্পের দূরত্ব সর্বমোট ৪০ কিলোমিটার।

একটা সময় ছিলো যখন এই প্রকল্পের স্থানে ছিল দুই মাইল প্রশস্ত নদী। এপার ওপার ছিল বিচ্ছিন্ন। পরে ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে ফেনী নদী এবং মুহুরি নদীর দু’তীরকে সেচ সুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আর সময়ে পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশের নানা প্রান্তের মানুষদের এটি নিয়ে বেড়েছে আগ্রহ ; হয়েছে শিক্ষাসফরের স্থান ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।

অপরূপা প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাড়াও এটি দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৪ সালে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের প্রথম বায়ু শক্তি চালিত বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপনের করে । তাছাড়া এটিকে দেশের বড় মৎসজোনগুলোর একটিও বড় মনে করা হয়।

এসব ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর এলাকা, সাহেরখালীসহ সমুদ্র উপকূলে জন্মাচ্ছে ছোট ছোট বীচ। তাছাড়া কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট আরশি নগর ফিউচার পার্কের মতো স্থানগুলো পর্যটকদের প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করে। তবে অবকাঠামো অনুন্নত থাকায় সুবিধা পাননা পর্যটকরা। তাই সকলেই বলছেন এই অঞ্চলের পর্যটন খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে অবকাঠামো উন্নয়নে জোরদার দেওয়া উচিত।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।