একগুচ্ছ চাবি থেকে হত্যার রহস্য উন্মোচন করলো পুলিশ

সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে নুরুন নবী হত্যা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে মো. নুরুন নবী (৫২) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন আসামি নুর মোহাম্মদ। ডাকাতের গল্প সাজিয়েও একগুচ্ছ চাবির অবস্থানের গরমিলের কারণে রেহাই পেলো না আসামি নুর মোহাম্মদ।

শনিবার (২২ জুলাই) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ।

অভিযুক্ত নুর মোহাম্মদ তেলের ডিপোতে টিনের ঘরে নিহতের সাথে থাকতেন। নুর মোহাম্মদ ট্রেলার গাড়ির হেলপার হিসাবে চাকুরি করতেন।

ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওই ব্যক্তির মরদেহের খবর পেয়ে আমি এবং কয়েকজন পুলিশ পরিদর্শক ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে নিহতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি এবং তার তিন ছেলে আবুল কালাম আজাদ, সাইফুল ও সাজ্জাদের সাথে কথা বলি।

নিহতের তিন ছেলের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, তাদের বাবা দীর্ঘদিন ধরে উসমানের তেলের ডিপোতে পাহারাদার হিসাবে চাকরি করতেন। এছাড়া দিনের বেলায় অটোরিকশা চালিয়ে বাড়তি উপার্জন করতেন। তাদের মা ১০ বছর আগে মারা যায়।

ঘটনার রাতে নুর মোহাম্মদ নিহতের ছোট ছেলে সাজ্জাদকে কল করে বলে, “ডাকাত পড়েছে, ডাকতরা চাচাকে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি পালিয়ে এসেছি”। এরপরে নিহতের তিন ছেলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তার বাবার মৃতদেহ দেখতে পায়। কিন্তু ঘটনাস্থলে নুর মোহাম্মদকে দেখতে না পেয়ে ৯৯৯-এ খবর দেয়।

ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থল ও নিহতের দেহ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে ডাকাতরা তাকে হত্যা করেনি। পরে নিহতের সাথে থাকা নুর মোহাম্মদকে কৌশলে ঘটনাস্থলে ডেকে নিয়ে আসা হয়। এরপর ডাকাতদের ঘটনাস্থলে এন্ট্রি এবং নুর মোহাম্মদের ঘটনাস্থল থেকে ডাকাতদের ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা রোল-প্লে করে দেখানোর জন্য তাকে অভিনয় করতে বলা হয়।

তিনি বলেন, নুর মোহাম্মদের রোল-প্লে করার সময় বেশকিছু সূত্র আমার কাছে চলে আসে। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তগুলো এবং তথ্য প্রযুক্তির আলোকে নুর মোহাম্মদের অবস্থান ও নিহতের ছেলেদের সংবাদ দেওয়ার সময় যাচাই বাছাই করি এবং একটি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি। এছাড়া ঘটনাস্থলে প্রবেশের মুখে যে টিনের তৈরি বড় গেইটের তালার চাবি যেখানে থাকার কথা রোল-প্লে এর মাধ্যমে জানতে পারি সেখানে চাবিটা না থেকে নুর মোহাম্মদের ব্যবহৃত গেঞ্জি দিয়ে মোড়ানো সুরক্ষিত অবস্থায় তাদের শয়নকক্ষের টেবিলের ওপর ছিল।

তিনি বলেন, আমরা নুর মোহাম্মদকে হেফাজতে নেই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জবাব দিয়ে আমাদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেও আমরা সদুত্তর পাইনি। আমি তাকে প্রশ্ন করি, “মূল গেইটের তালার চাবি তালার সাথে না থেকে তোমার গেঞ্জির মধ্যে কিভাবে আসলো”? এর উত্তরে আসামমি নুর মোহাম্মদ আটকে যায়।

আসামি নুর মোহাম্মদের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, রাত ১টার দিকে নিহত নুর নবীর কাছে একটি কল আসে। তখন সে নুর মোহাম্মকে ঘুম থেকে ডেকে বলে, “তেলের গাড়ি আসছে, তুই গেইট খুলে দিয়ে আয়”। নুর মোহাম্মদ গেইট খুলে দিতে না দিতেই চারজন মুখোশ পরা লোক তাহাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। সে তখন প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

ওসি বলেন, আমরা তখন তাকে প্রশ্ন করি, “পালিয়ে গেলে চাবি হয়তো তোমার কাছে থাকবে, নয়তো বা তোমার পকেটে থাকবে। চাবি তোমার গেঞ্জি দিয়ে মোড়ানো টেবিলের উপর থাকবে কেন”? এই প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে জেরার মুখে সে হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। পরে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে হত্যার দায় স্বীকার করেন।

জবানবন্দিতে আসামি নুর মোহাম্মদ বলেন, প্রায় ৭-৮ মাস আগে নিহতের রিকশায় করে যাওয়ার সময় তাদের পরিচয় হয়। নিহত নুর নবী আসামি নুর মোহাম্মকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় যাবে”? তখন উত্তরে সে বলে, “আমি একটা বাসা নিয়েছি ওইখানে যাবো। আমি গাড়ির হেলপার আমাকে প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা করে বাসা ভাড়া দিতে হয়”।

এর পরে মৃত নুর নবী বলে, “তুমি আমার সাথে থাকো, মাসে ১ হাজার টাকা করে দিলে হবে”। কম বাসা ভাড়া হওয়ায় সে এই শর্তে রাজি হয় এবং তার সাথে একত্রে বসবাস করতে থাকে। হঠাৎ ১০-১৫ দিন পরে রাতে তাকে পেপসি খেতে বলে। প্রথম দিন সে পেপসি খেয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লে তাকে নুর নবী বলৎকার করে। এরপর থেকে নুর নবী প্রায় সময় মদ খেয়ে নুর মোহাম্মদকে বলৎকার করত।

আসামির জবানবন্দির বরাত দিয়ে ওসি বলেন, ঘটনার রাতে ১টার দিকে নুর মোহাম্মদকে বলৎকার করলে সে বেশি ব্যাথা পায় এবং নুর নবীকে লাথি মেরে ফেলে দিলে মেঝেতে পড়ে থাকা কাঠের সাথে সংযুক্ত তার কাটার সাথে লেগে মাথায় রক্তাক্ত আঘাত পায়। তারপর আসামি নুর মোহাম্মদ একটি সাদা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ভুক্তভোগী নুর নবীকে গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করে এবং সাথে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তার মনে পড়ে সে যেখানে থাকুক না কেন পুলিশের হাতে ধরা পড়বেই। আর তাই সে ডাকাতদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে একটি গল্প তৈরি করে ভুক্তভোগীর ছেলেদের খবর দেয়। কিন্তু পুলিশের দক্ষতার কাছে তার সব পরিকল্পনা হার মানলো।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে সলিমপুর ইউনিয়নের সাঙ্গু-অক্সিজেন সড়ক এলাকায় পোড়া তেলের ডিপো থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। নুরুন নবীর গলায় বৈদ্যুতিক তার প্যাঁচানো ছিলো এবং মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত নুরুন নবী ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের সমপুর গ্রামের বজলুল রহমানের ছেলে। নুরুন নবী ওই এলাকায় ওসমান নামে এক ব্যক্তির পোড়া তেলের ডিপোতে কাজ করতেন। সেখানে স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে পোড়া তেল সংগ্রহ করে বিক্রি করা হতো। ওই ডিপোর একটি কক্ষে থাকতেন তিনি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।