চবিতে নারী সাংবাদিককে ‘বুলিং’, মোবাইল-ব্যাগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা—চবিসাসের নিন্দা

অন্যসব দিনের মতো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববদ্যিালয়ের (চবি) শহীদ মিনার এলাকায় চারুকলার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী মারজান আকতার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস) সদস্য এবং দৈনিক সমকালে কর্মরত এই নারী সাংবাদিক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধর, ও ব্যানার ফেস্টুন কেড়ে নিতে দেখে ভিডিও ধারণ করতে শুরু করেন। এসময় মারজান আক্তারের ওপর চড়াও হয়ে তাকে হেনস্তা ও হুমকি-দমকি দিতে থাকেন চবি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপ ভার্সিটি এক্সপ্রেসের (ভিএক্স) নেতাকর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে চবিসাস।

চবির এই ‘নারী’ সংবাদকর্মীকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে ‘হেনস্ত ‘ করার একটি ভিডিও ফুটেজ চট্টগ্রাম খবরের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, ভিএক্স গ্রুপের অনুসারী ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ ইসলাম, বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী তৌহিদুল হক ফাহাদ, একই সেশনের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শহীদুর রহমান স্বপনসহ আরও ১০-১৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী ওই নারী সাংবাদিককে ঘিরে ধরে জেরা করছেন। এসময় তার মারজানের মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দমকি দিতে থাকে। ‘তোর নিরাপত্তা কে দেয় আমরা দেখবো’—এমন কথা বলে ‘বুলিং’ করতেও দেখা যায় তাদের।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ভুক্তভোগী সাংবাদিক যখন ছাত্রলীগকর্মীদের জটলা থেকে বেরিয়ে আসছিলো তখন তাদের একজন তার ব্যাগ ধরে টান দেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ‘হায়নার’ মতো বাড়িয়ে দেওয়া সেই হাত কি ব্যাগে লাগছে না শরীরে লাগছে সেই চিন্তা করার বোধটুকুও যেন ছিলোনা উপস্থিত ছাত্রলীগকর্মীদের। যদিও শেষ মুহূর্তে ভুক্তভোগী নারী সাংবাদিক ‘দীপ্ত পায়ে’ ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

এসব বিষেয়ে ভুক্তভোগী মারজান আকতার বলেন, ছাত্রলীগের অনুসারীরা যখন চারুকলার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিচ্ছিলেন, তখন পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে আমি ফুটেজ নিচ্ছিলাম। এ সময় ছাত্রলীগের ভিএক্স গ্রুপের অনুসারীরা এসে আমাকে আটকায় এবং ভিডিও ডিলিট করার জন্য চাপ দিতে থাকে। আমি ভিডিও ডিলিট করবো না বলায় তারা আমাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। এ সময় তারা বলছিলো ‘তোর নিরাপত্তা কে দেয় আমরা দেখবো’। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে আমার সঙ্গে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। পরে আমি সেখান থেকে আসার সময় তারা আমার মোবাইল এবং ব্যাগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

পরবর্তীতে আবারও সাংবাদিকদের সাথেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন একই গ্রুপের কর্মী সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী মারুফ হাসানসহ আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ-কর্মী। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস)।

অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। চবি সাংবাদিক সমিতির দপ্তর, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোহাম্মদ আজহার স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে চবিসাস সভাপতি মাহবুব এ রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ইমাম ইমু এক বিবৃতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

নেতৃবৃন্দ বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের সাথে এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এছাড়া ছাত্রলীগের এ ধরনের হিংস্র আচরণ স্বাধীন সাংবাদিকতার অন্তরায়। বাক স্বাধীনতার পাশাপাশি মুক্ত গণমাধ্যমকেও কলুষিত করে এসব কর্মকাণ্ড। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, চারুকলার শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থানের বিষয়ে আগে থেকে আমাদেরকে কিছু না জানানোর কারণে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। ঘটনাস্থলে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা না থাকায় এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে আমরা আগেও ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নেয় চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এরপর সাড়ে দশটায় টায় ছাত্রলীগের ২ উপগ্রুপ বাংলার মুখ, এবং ভিএক্স’র নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের বাধা প্রদান করেন। এসময় ব্যানার ফেস্টুন কেড়ে নেয় ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চড় থাপ্পড় মারেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় শহীদ এলাকায় বাধার মুখে ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা পরে জিরো পয়েন্টে (স্মরণ চত্বর) এসে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে তারা প্রক্টর অফিসে গিয়ে প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ প্রদান করেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ভিএক্স গ্রুপের নেতা মারুফ ইসলাম বলেন, চারুকলার আন্দোলনে আমাদের কিছু ছেলে অংশগ্রহণ করেছিল। আমরা তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম। আমাদের ছেলেদের বাইরে অন্য কাউকে কোনো বাধা দেয়নি।
সাংবাদিক হেনস্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সাংবাদিককে প্রথমে সাধারণ শিক্ষার্থী মনে করেছিলাম। তাই ভিডিও ডিলিট করতে বলি। কিন্তু তিনি যখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়েছেন তখন আমরা আর কিছু বলিনি।

বাংলার মুখের নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবু বকর তোহা বলেন, আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিবে। আমার গ্রুপের কেউ যদি কিছু করে সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের দলীয় কোন সিদ্ধান্ত না। তাদের বিরুদ্ধে যদি কোন তথ্যপ্রমাণ থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনার বিষয়ে অবগত আছেন বলে জানিয়েছেন চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজউল হক রুবেল। এছাড়া বিষয়টি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে অবহিত করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, চবিতে সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকে প্রক্টর পরিচয়ে হুমকি দিতেও সাহসের অভাব হয়নি ছাত্রলীগ কর্মীর। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিচারের আওতায়ও এনেছে প্রশাসন

তবে চবি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীকে ‘মারাত্বক বিপথগামী’ বলে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।