চবি শাটল দুর্ঘটনা—আইসিইউর দুইজন চবির শিক্ষার্থী নন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটলে গাছের আঘাতে আহতদের তিনজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। তারা হলেন—আমজাদ হোসেন সোহাগ (১৮), খলিলুর রহমান (২২) এবং অংসইনু মারমা (২১)।
তাদের শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এদের মধ্যে কেবল অংসইনু মারমাই চবি শিক্ষার্থী। অংসইনু মারমার অবস্থা তিনজনের মধ্যে তুলনামূলক ভালো ছিল শুরু থেকেই। চিকিৎসকরা শুক্রবার সকালেই জানিয়েছেন তার অবস্থা স্থিতিশীল। অপর দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

দুর্ঘটনায় আমজাদ হোসেন সোহাগ ও খলিলুর রহমানের অবস্থা নিয়ে শুরু থেকেই শঙ্কা ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের রক্তাক্ত ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদেরকে যখন সিটি স্ক্যান করতে আনা নেওয়া হচ্ছিলো তখনও একজনের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিলো।
তাদের রক্ত দরকার হলে রক্ত দেয়ার জন্য চবির অসংখ্য শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান নিয়েছিলেন। চিকিৎসক কিংবা রক্তদাতাদের কাছে পরিচয় মূখ্য নয়, মানবিকতাই মূখ্য। চিকিৎসকরাও আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাদের সারিয়ে তুলতে। নিওরো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রবিউল করিম দিনের রুটিন ডিউটি শেষে বিশ্রামের সময়টাতে হাসপাতালে রাত জেগে অসুস্থদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন।

বিপত্তির জায়গা হলো, আমজাদ এবং খলিলের বিভৎস ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর করা। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের কেউ বলছেন কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে, আবার কেউ বলছেন ৩০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে!
কারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে? তাদের পরিচয় কী? এ প্রশ্নে তারা ছড়াচ্ছেন বিভ্রান্তিও। অথচ তাদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট!
অনেকের শঙ্কা অতীতের ঘটনার মতো এবারের জ্বালাও পোড়াওয়ে জড়িতরাও হয়তো পার পেয়ে যাবে। অথবা মূল হোতাদের পরিচয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নত হয়ে কিছু সাধারণ শিক্ষার্থীকে বলিরপাঁঠা বানাবে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে।

কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কী?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। শাটলে বহিরাগত কেন? গত এক বছরে একাধিক ছাত্রী শহরে টিউশন বা ব্যক্তিগত কাজ সেরে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বহিরাগতদের হাতে শাটল ট্রেনে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষের ‘শাটল ভিজিট’র মতো লোক দেখানো দু’একটা কর্মসূচি চোখে পড়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি।
এই দুর্ঘটনায় আহতদের তালিকায় মনি নামের ২২ বছরের বহিরাগত এক নারীও ছিলেন!

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে সফল বা ব্যর্থ এই বিতর্ক উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন—“একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম্মায় থাকা সবচে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ তার শিক্ষার্থীরা। সেই শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষায় গাফলতি বা শিক্ষার্থীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে রাখা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।”

দুর্ঘটনার পর শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটির ঘোষণা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অপর দিকে তিনটি মামলার কথা জানালেও মামলার এজাহার কিংবা কারা আসামি সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে পুলিশ জানে। হাটহাজারী থানার ওসি বলছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলছেন ওসি জানেন।
এই জানা—না জানা কিংবা অমুক-তমুকে জানাই ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ‘খেলা’ রহস্যের জন্ম দিচ্ছে।

আহতদের মধ্যে আবু সাইদ (২৪), সান আহমেদ (২১) আছেন হাসপাতালের নিওরো সার্জারি ওয়ার্ডে। তাইজুল ইসলাম (২১), রাফসান (২৩) ও আসলাম (২২) নামের ৩ শিক্ষার্থী নিওরো সার্জারি ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়ে বহিরাগত ওই নারীসহ অপর ৮ শিক্ষার্থী হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন বলে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম খবরকে নিশ্চিত করেছেন।
অর্থাৎ শনিবার দুপুর পর্যন্ত তিন শিক্ষার্থী আছেন হাসপাতালে। বাকীরা সবাই চিকিৎসা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

প্রসঙ্গত, চৌধুরীহাট এলাকায় রেললাইনের জায়গায় গাছের ডালপালা ঝুলে ছিল। শাটল ট্রেন চৌধুরীহাট ক্রস করার সময় বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টায় স্টেশন ছেড়ে যাওয়া শাটল ট্রেনের ছাদে থাকা শিক্ষার্থীরা ঝুলে থাকা গাছের সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে ট্রেনটি ফাতেয়াবাদ স্টেশনে থামলে আহতদের নিচে নামিয়ে আনেন অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। আহতদের স্থানীয় ক্লিনিক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন তারা।
শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছালেই শিক্ষার্থীরা নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক আটকে দেন। এ সময় তারা আগুন জ্বালিয়ে প্রশাসনের নিকট শিক্ষার্থী আহতের জবাব ও শাটল ট্রেনের বগি বাড়ানোর দাবি জানান। এছাড়াও জিরো পয়েন্টে অবস্থিত পুলিশ বক্সে ভাঙচুর চালায় শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা বগি বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করেছেন। কর্তৃপক্ষ সব সময় তাদের আশ্বস্ত করেছেন বগি বাড়াবেন। মাঝে এসি ট্রেনের ঘোষণাও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু সব কিছুই ওই ঘোষণা পর্যন্তই রয়েছে। নিশ্চিত হয়নি নিরাপদ পরিবহণ।
এটাও ঠিক আইসিইউতে শঙ্কাজনক চিকিৎসা নেওয়া বহিরাগত দুই জনের স্থলে চবির কোনো শিক্ষার্থীও থাকতে পারতেন। তাই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দাবী—টেনের বগি বৃদ্ধি করে ক্যাম্পাস থেকে শহরে ছাত্র-ছাত্রী সবার যাতায়াত নিশ্চিত হোক।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।