‘জীবন এতো তুচ্ছ নয়, আমরা আনবো সূর্যোদয়’

আত্মহত্যা রুখতে আঁচলের শপথ অনুষ্ঠান

হতাশামুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আত্মহত্যা রুখতে শিক্ষার্থীরা শপথ গ্রহণ করেছেন । শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারম্যান শান্তা তাওহীদা।

শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারী) বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্যে ক্যাম্পেইন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো আঁচল ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস আমানুল্লাহ, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারপারসন শান্তা তাওহিদা এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন- “আমরা দেখছি আত্মহত্যার হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলছে। করোনার প্রভাবের পাশাপাশি আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হওয়ায় মানুষের মাঝে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর ফলেই আত্মহত্যা সংখ্যায় এ পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আত্মহত্যা রোধ করতে অন্যদের পাশাপাশি আমাদের তরুণদেরও ভূমিকা পালন করতে হবে। সারাদেশের শিক্ষার্থী ও তরুণদেরকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন করার জন্যই আজকে আমাদের এই উদ্যোগ। প্রতীকী শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সেই বার্তাটাই সবার দুয়ারে ছড়িয়ে দিতে চাই।”

আঁচল ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি সামিরা আক্তার সিয়াম বলেন, “আমরা দেখেছি আঁচলের জরিপ থেকে উঠে আসে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক দুশ্চিন্তা, সম্পর্কগত কারণ, আর্থিক সমস্যা, পড়াশুনা, মাদকাসক্ত, পারিবারিক সমস্যাসহ আরও বেশ কিছু কারণে। তরুণ শিক্ষার্থীরা যেনো মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণে এমন ধ্বংসের পথ বেছে না নেয় সেটাই এই ক্যাম্পেইনে গৃহীত শপথের মাধ্যমে আমরা জানান দিতে চাই। নিজেদের ও আশেপাশের মানুষের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।”

আঁচল ফাউন্ডেশনের অপারেশনাল সেক্রেটারি জিনাতুল জাহরা ঐশী উক্ত ক্যাম্পেইনে বলেন, “তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য কি অবস্থায় আছে তা জানতে আঁচল ফাউন্ডেশন বরাবরই নানান ধরণের জরিপ পরিচালিত করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় যখন দেখা গেলো যে করোনাকালীন সময়ে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার চিন্তা করেছে তখন আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে আমরা শিক্ষার্থী ও তরুণদের সচেতন করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমরা চাই সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের এ উদ্যোগের সাথে যুক্ত হোক। সম্মিলিতভাবে সবাই কাজ করলে আত্মহত্যা কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”

শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারম্যান শান্তা তাওহীদা বলেন- “প্রতিটি মানুষেরই শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। মনের যত্ন নেওয়ার বিকল্প নেই। এই কাজটি আমাদের করার কথা ছিলো, কিন্তু আমাদের সমাজের তরুণরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে। এই ধরনের গবেষণা এবং উদ্যোগ আরো বেশি বেশি নেওয়া উচিত। এখানে উপস্থিত পঞ্চাশ জন তরুণ আজ যদি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হয় তবে তার সাথে সচেতন হবে পঞ্চাশটি পরিবার। এভাবেই সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে আঁচল ফাউন্ডেশনের মতো পদক্ষেপ নেয় তাহলে আমরা একটি সুস্থ্য সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। সবাই মিলে আত্মহত্যাবিহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।”

প্রসঙ্গত, ক্যাম্পেইনটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, আত্মহত্যা রোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সেই লক্ষ্যে, নিজেদের এবং আশেপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে একটি শপথ বাক্য পাঠ করা হয়েছে, যেন আমরা নিজ সক্ষমতা ও শক্তিগুলো উপলব্ধি করার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া থেকে বিরত থাকি এবং আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোকে এই পথ বেছে না নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে পারি। সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে যে সব পোস্টারে লিখিত ট্যাগলাইন প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো হলো, “জীবন এতো তুচ্ছ নয়, আমরা আনবো সূর্যোদয়”, আজকে যদি ছেড়ে দেই, কালকের গল্প লিখবে কে?, লেট’স টেইক আ স্টেপ টু স্টপ সুইসাইড, স্টপ জাজিং, আই অ্যাম কনফিডেন্ট টু লিভ, হাল ছাড়বো না সফল হবোই, ইউ অলওয়েজ ম্যাটার, আমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে চাই ইত্যাদি। সর্বোপরি, আত্মহত্যার প্রতি শূন্য সহনশীলতা দেখিয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখাই এই ক্যাম্পেইনের মূল বার্তা।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পূর্বে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি পর্যন্ত একটি র‍্যালি পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন।

প্রসঙ্গত, আঁচল ফাউন্ডেশন একটি তরুণ সংগঠন যা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তরুণরা যেসব কারণে হতাশা, হীনমন্যতায় ভূগে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সেসকল দিক বিবেচনায় আঁচল ফাউন্ডেশন বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেই প্রজেক্টগুলোর মাধ্যমে তরুনদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি হতাশামুক্ত সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ২০১৯ সাল থেকে এগিয়ে যাচ্ছে আঁচল ফাউন্ডেশন।

আচঁল গত ২৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা বিষয়ক সমীক্ষা প্রকাশ করে। ফলাফল অনুযায়ী, ২০২১ সালে সর্বমোট ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে যা ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ। এরমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সর্বোচ্চ, যা ৬২ জন। সমন্বয়কৃত তথ্য অনুযায়ী, পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, সম্পর্কজনিত জটিলতার কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বাধিক। এক বছরে এতো বেশি সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর আত্মহনন আমাদের সমাজ তথা পুরো দেশের জন্য হুমকিস্বরুপ।

এফএম

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।