তামাক নামক ‘বিষ’ চাষে ঝুকছে পাহাড়ের কৃষকরা, নেই সুনির্দিষ্ট আইন!

নির্দিষ্ট আইন না থাকায় ক্ষতিকর তামাক চাষে ঝুকছে পাহাড়ের কৃষকরা। কোম্পানিগুলোর চমকপ্রদ প্রস্তাবে ঋণের জালে বন্দি হয়ে তামাক চাষ করছেন তারা। কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষককে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বিকল্প ফসল চাষে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে তামাক চুল্লিতে দৈনিক শত শত মণ গাছ, কাঠ পুড়ানোর ফলে একদিকে যেমন উজাড় হচ্ছে বন, ঠিক তেমনি ভারসাম্য হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদুতে বগাচতর, গুলশাখালী ও আটারকছড়া ইউনিয়নে এবং অন্যান্য ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় শত শত বিঘা জমিতে এখন তামাক চাষ করছে কৃষকরা। ক্ষতিকর জেনেও অধিক লাভের আশায় জমিতে বিষ ফলাচ্ছেন তারা।

পাহাড়ের কৃষক রফিকুল, শাহ আলম ও রহিমা খাতুনসহ অনেকে জানান, ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ফলাচ্ছে তামাক। তামাক চাষে যেমন একদিকে জমির উর্বরতা নষ্ট হয় অন্যদিকে তেমনি শরীরে বাসা বাদে নানান রোগ। অনেক কৃষক এখন শ্বাসকষ্ট সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। তবে সরকারি প্রণোদনার শতভাগ নিশ্চিত সহ পার্বত্যাঞ্চলের কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানান তারা।

তামাক চাষী ফজলে করিম জানান, পাহাড়ে পানি সংকটের ফলে এ চাষে ঝুকছেন তারা। ধান বা অন্য ফসলে সেচ বেশি প্রয়োজন হলেও তামাকে খুব কম। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কেউ কেউ তামাক চাষ করছেন। এছাড়া তামাক চাষে কোম্পানি গুলো অগ্রিম ঋণ, সার, ওষুধ, বীজ, কীটনাশক সহ বিভিন্ন সহযোগিতার ফলে কৃষকদের নিজ থেকে অর্থ ব্যয় করতে হয় না। তাই বিক্রির পর লভ্যাংশের কিছু অর্থ দিয়েই তাদের সংসার চালাতে পারেন।

স্থানীয় জনসাধারণের দাবি তামাক চাষ রোধে প্রশাসনের এগিয়ে আসা জরুরী। দেখা গেছে তামাক পাতা পোড়ার একমাত্র কাঁচামাল হিসেবে কাঠ বা লাকড়ি কাটার নামে বন উজাড় হচ্ছে।

সচেতন সমাজ বলছেন, লংগদুতে তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে সূর্যমূখী, ধান, ভূট্টা ও গম চাষ করতে কৃষকদের আরো বেশি আগ্রহী করতে হবে। জেলা ও উপজেলা কৃষি অফিস সহযোগিতা করলে এ অঞ্চলের তামাক চাষের বিকল্পে কৃষি উৎপাদন বাড়বে।

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের উল্টাছড়ি বন কর্মকর্তা এএসএম মাহাবুব উল আলম জানান, পার্বত্যাঞ্চলে অধিক তামাক চাষের ফলে যেমনি নষ্ট হচ্ছে ফসলী জমি, ঠিক তেমন উজার হচ্ছে বন; ভারসাম্য হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আইনশৃঙ্খলা সভা সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তামাক চাষ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করারও আহ্বান জানিয়েছি। এছাড়া কোনো তামাক চাষি যদি এ চাষ থেকে বের হয়ে অন্য চাষে আগ্রহ দেখায় আমরা তাকে সহযোগিতা করবো।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, কোম্পানি গুলোর অধিক প্রলোভনে কৃষকরা তামাক চাষ করছে। তবে কৃষকদের এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বিকল্প ফসল চাষে সরকারি বিভিন্ন প্রণোদনা ও সহায়তার কথা জানান।

লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জানান, তামাক চাষে সরকার কৃষকদের বারবার নিরুৎসাহী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই চাষে পরিবেশ ও কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। কৃষি অফিসের সহায়তায় কৃষকদের অন্য ফসল চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে, তামাক চাষ থেকে বিমুখ করতে হবে। তবে এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে উপজেলায় ৫০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষের কথা বললেও বাস্তবে এই পরিসংখ্যানের ১০ গুণেরও অধিক জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য হানিকর ভেষজ দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে ১৮(ক) ধারায় দেশের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নাগরিকের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় তামাক চাষ বন্ধে কার্যকর ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রের কোনো বাধা নেই। অন‍্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স কনফারেন্সে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।