পাহাড়ে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে জারুলের বেগুনি রঙ

সবুজ পত্র-পল্লবের অগ্রভাগে সারিবদ্ধভাবে ফুটে আছে বেগুনি রঙের ফুল। কোনটি আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে হাসছে আবার কোনটি পাশের ডালে ‘হেলে-ঝুলে’ পথিকের সাথে ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত। কোনটি বাতাসের সাথে নেচে নেচে মৌমাছিদের ডাক দেয় আবার কোনটি খসে পড়ে আলিঙ্গন করে মৃত্তিকাকে। ঠিক এভাবে গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে প্রকৃতির রুক্ষতাকে ঢেকে দিয়ে স্নিগ্ধতায় চারদিক ভরিয়ে দিয়েছে জারুল।

বৈচিত্রময় প্রকৃতির এই দেশের প্রায় প্রতিটি কোণে-ই এখন চোখে পড়ছে এই দৃশ্য। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রকৃতিতে জারুলের বেগুনি রঙের মুগ্ধতা যেন একটু বেশিই। রাঙামাটির লংগদুর সবুজ প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের খরতাপ আড়াল হয়ে গেছে গাঢ় বেগুনি রঙের মনমাতানো জারুলের সৌন্দর্যে। পাহাড়ি পথের ধারে ধারে ও বাগানে জারুল ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্যে তপ্ত প্রকৃতি যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যে রূপ নিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বৈশাখের তপ্ত আবহাওয়াতেও লংগদুর বিভিন্ন এলাকার সড়কের পাশে ও কিছু এলাকায় ঝাড়লণ্ঠনের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে গাঢ় বেগুনি রঙের মনকাড়া রূপে পসরা সাজিয়ে রেখেছে জারুল। এ ফুলের নমনীয় পাপড়ির কোমলতা, দৃষ্টিনন্দন বর্ণচ্ছটায় তপ্ত বৈশাখেও যেন মনে প্রশান্তি এনে দেয়। জারুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য নজর কাড়ছে পথচারীসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের। ফুলের প্রেমে বিহ্বল হয়ে কেউ কেউ ফুলের সঙ্গে তুলছেন সেলফি। প্রস্ফুটিত এসব ফুল মোবাইল ফোনে বন্দি করছেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

স্থানীয় সংবাদকর্মী বিপ্লব ইসলাম বলেন, গ্রাম-বাংলায় জারুল একটি অতিপরিচিত নাম। প্রতি গ্রীষ্মে এই গাছে প্রকৃতিকে মাতিয়ে ফুল ফোটে। জারুল ফুল দেখতে বেশ সুন্দর। সবুজ প্রকৃতিতে জারুল ফুলের উপস্থিতি ফুলপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে। এটি যেকোনো জায়গায় এমনি এমনিতেই জন্মায়।

আরেক বাসিন্দা কিবরিয়া বলেন, এই অঞ্চলের মানুষের কাছে জারুল একটি পরিচিত নাম। এ গাছের ফুল প্রতি বৈশাখ এলেই ফোটে। এ গাছের কাঠ শক্ত ও টেকসই। এ গাছের কাঠ এক সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হতো। এর কাঠ শক্ত হওয়ার কারণে লাঙল, নৌকা, খুঁটি ও ঘরের নানা ধরনের আসবাবপত্র তৈরিতেও ব্যবহৃত হতো। তবে এ গাছটি আগের মতো আর দেখা যায় না।

জারুলের এই সৌন্দর্যে কে-ই বা মুগ্ধ না হবে। মন হরণ করা সৌন্দর্যের কারণে বাংলা কবিতায়ও স্থান করে নিয়েছে জারুল। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশও জারুলের প্রেমে পড়ে কবিতায় জারুলকে তুলে এনেছেন এভাবে—

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে- সবচেয়ে সুন্দর করুণ/ সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ।’

তিনি আরও লিখেছেন —‘ভিজে হয়ে আসে মেঘ দুপুরের চিল একা নদীটির পাশে, জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে।’

জানা গেছে, জারুলের বাকল মসৃণ; রং ধূসর; ফুল গাঢ় বেগুনি। জারুল কাঠ শক্ত ও মসৃণ। এর কাঠ লালচে রঙের হয়। জারুল কাঠ দিয়ে পানির নিচেও কাজ করা যায়। এ গাছের উচ্চতা ৮০-১০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। জারুলের বৈজ্ঞানিক নাম লেজারস্ট্রমিয়া স্পেসিওজা। বৈজ্ঞানিক এ নামের প্রথমাংশ অন্যতম তরু অনুরাগী সুইডেনের লেজারস্ট্রমের নাম থেকে। আর স্পেসিওজা একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ সুন্দর। এই গাছটির আদি নিবাস চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয় ও বাংলা-ভারতের জলাভূমি অঞ্চল। ইংরেজিতে এই গাছকে ‘প্রাইড অব ইন্ডিয়া’ বলা হয়। তবে এটিকে বাংলার চেরিও বলা হয়।

লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক তৌহিদুল রেজা বলেন, প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই মানুষের কোনো না কোনো কল্যাণ রয়েছে। জারুলসহ প্রতিটি গাছ ও উদ্ভিদ মানুষের কল্যাণেই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। জারুল ফুল এই সময়টাতে ফোটে। এই ফুলের মনোহর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট না হওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে এ গাছ শুধু সৌন্দর্যবর্ধনই করে না, এর রয়েছে ভেষজ গুণ। এর বীজ, ছাল ও পাতা ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ছাড়াও জ্বর, কাশি, অনিদ্রা ও শারীরিক বিষন্নতায় জারুলের ভূমিকা অপরিহার্য।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।