প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ঝুলছে তালা, থাকেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা!

পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটির লংগদুতে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের অনেকগুলো ঘরেই ঝুলছে তালা। এতে থাকছেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা, যারা থাকছেন তাদেরও আছে নানান অভিযোগ। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বিদ্যুৎ না থাকা, নষ্ট টিউবওয়েল এবং ঘরে বাইরে ফাটল ধরায় এসব ঘরে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, লংগদুর প্রত্যন্ত কালাপাকুজ্জ্যা ইউনিয়নের বাজার টিলা ইসলামপুর এলাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ ৩৪টি ঘরের মধ্যে ২৪টি ঘরে বসবাস করেন লোকজন। ফাঁকা ১০টি ঘরে এখন খড়কুটো ও গরু-ছাগল রাখা হয়। আবার কোনো কোনো ঘরে অসহায় দরিদ্র পরিবারের বসবাস রয়েছে মালিক পক্ষের অনুমতিতে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার ২ নম্বর কালাপাকুজ্জ্যা ইউনিয়নের ইসলামপুর এলাকায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের এক পাশে ১৫টি, অন্য পাশে ১৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫টির মধ্যে ১১টিতে পরিবার বসবাস শুরু করলেও এখনো ঘরে ওঠেননি ৪টি পরিবার। তার মধ্যে ২টি ঘর তালাবদ্ধ। অন্য পাশে ১৯টি ঘরের মধ্যে ১৩টির মালিক পরিবার নিয়ে বসবাস করলেও ৪টি ঘর তালাবদ্ধ। অন্য ২টিতে থাকেন আশ্রয়হীন অসহায় দুই পরিবার। নির্মাণ করা কয়েকটি ঘরের দেয়াল ও মেঝেতেও ফাটল ধরেছে। কোথাও কোথাও ধসে পড়েছে ঘরের বিভিন্ন অংশ।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা জানান, ঘরে তালা দিয়ে বেশিরভাগ লোকজনই চলে গেছেন। তাদের কেউ থাকেন নিজ বাড়িতেই, কেউ থাকেন এলাকার বাহিরে। এমনও আছেন, শুধু ঘর তালাবদ্ধ করে চলে গেছেন, আর কখনো আসেননি। এ জন্যই বেশিরভাগ ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। জায়গা কম পড়লে কেউ ফাঁকা ঘরগুলোতে খড়কুটো ও গরু-ছাগল বেঁধে রাখছেন। প্রকল্পের এই ঘরের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে এবং ঘরের মেঝেতে ইঁদুর গর্ত করেছে বলে অভিযোগ করেন আশ্রয়ণের বাসিন্দারা।

আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ১৭ নম্বর ঘরে বসবাস করেন মুজিবুর মিয়া। তবে এই ঘরের প্রকৃত মালিক টুনু মিয়া। মুজিব বলেন, অনেকদিন ধরে নিজের কোনো ভিটেমাটি ও ঘর না থাকায় টুনু মিয়ার সম্মতিতে পরিবার নিয়ে এখানে আছি। বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় নেতাদের ধরেও তিনি ঘর পাননি বলে অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নারী বলেন, যারা ঘর পেয়েও সেখানে থাকছেন না, তাদের আগে থেকেই বড় বড় ঘরবাড়ি রয়েছে। তাই তারা এসব ঘর নামের মুরগির খুপরিতে থাকছেন না, শুধু দখলে রেখেছেন। এই এলাকাতেই ভূমিহীন অনেকে রয়েছেন, যারা ঘর পাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশেই বসবাসকারী দুই নেতার দুইটি ঘর বরাদ্দ রয়েছে। তারা হলেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৯ নম্বর ঘরের মালিক মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি কালাপাকুজ্জ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে আছেন। অপরদিকে ৭ নম্বর ঘরের মালিক সাত্তার একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব রয়েছেন। কিন্তু তারা কেউ সেখানে থাকেন না। কারণ তাদের আগে থেকেই বড় বড় ঘর আছে। ১০-১২টি গরু-ছাগল আছে। বিঘায় বিঘায় আবাদি জমি। সে কারণে তারা ওই ছোট ঘরে থাকতে চান না।

প্রকল্পের ১৫ নম্বর ঘরের মালিক রাজ্জাক। তবে সেখানে এখন থাকেন ময়না বেগম। তিনি বলেন, গত ২ বছর ধরে এই ঘরে আছি। সরকারি ঘর পায় বড় লোকে, আমরা গরিব তাই ঘর পাই না! আপনাদের কাছে অনুরোধ করি আপনারা আমার বাচ্চা নিয়ে থাকার জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেন।

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ঝুলছে তালা, থাকেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা! 1

জয়নব নামে একজন বলেন, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে এক বছর ধরে থাকতেছি। এই ঈদের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কেউই কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। ঈদ খুব কষ্টে কাটাতে হয়েছে। আগে ইউএনও স্যার আসতো, আমাদের ভালো মন্দ দেখতো-জানতো; বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা করতো। এখন কেউই কোন খোঁজ খবর নেয় না এবং সরকারি কোনো অনুদান পাই নাই।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীরা আরও জানান, ৩৪টি পরিবারের জন্য মাত্র ৬টি টিউবওয়েল দেয়া হলেও সেখান থেকে ২টি সম্পূর্ণ এবং ১টি আংশিক নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে তারা এই তীব্র তাপদাহেও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন। এছাড়াও সরকারি অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা পান না বলেও আক্ষেপ তাদের!

জানতে চাইলে ইসলামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতি মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ৩-৪ মাসে একদিন থাকে বরাদ্দপ্রাপ্ত ঘরের মালিকরা। তাদেরকে এমনও বলা হয়েছে নিজেদের আশ্রয়ণের ঘর প্রয়োজন না হলে স্থানীয় অসহায় লোকদের দেওয়ার জন্য। তবুও তারা কারো কথা মান্য করে নাই। পরে তৎকালীন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবগত করেও কোন ফল পাইনি। তবে ঘরগুলো ভূমি-গৃহহীন মানুষেরই প্রাপ্য।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক দেওয়ান জানান, আমি বিষয়টি প্রথম থেকে জানার পরই আশ্রয়ণ পল্লীতে গিয়ে যারা থাকে না তাদের ঘরের ক্রমিক নম্বর ও মালিকের নামসহ তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখনও পর্যন্ত এর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং পূর্বের অবস্থাই বিদ্যমান।

লংগদু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিলন চাকমা জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর কার্যক্রমের সময় আমি ছিলাম না, এখানে আমি সদ্য এসেছি। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, বরাদ্দ পাওয়া ঘরে উপকারভোগীদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া হবে। যারা ঘরগুলোতে থাকতে চান না, তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীদের সৌর-বিদ্যুৎসহ সব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছি। আর বিশুদ্ধ পানির সংকটে দূরীকরণে নতুন করে টিউবওয়েল প্রদান করা হবে। এছাড়া তদন্ত করে যৌক্তিক সকল সমস্যা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করার চেষ্টা করবো।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।