বাবা বলে ডাকার কেউ রইলো না ওদের!

রাহিন, তাসফিয়া, নিশাত,মারিয়া —ফুটফুটে চার শিশু। প্রতিদিন রাত জেগে অপেক্ষা করতো বাবা ফিরে আসার। দিনভর সিএনজি চালিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে বাবা শেখ ফরিদ ও শেখ সুমন বাড়িতে এসেই জড়িয়ে ধরতেন সন্তানদের। পকেট থেকে বের করে দিতেন চকলেট,চিপস। আর সেই চকলেট ,চিপস নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে কত খুনসুটি! তখন বাবা বাবা করে শিশুরা ব্যস্ত হয়ে যেতেন একে অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ দিতে। আর শেখ ফরিদ,শেখ সুমনও এটা ওটা বলে চেষ্টা করতেন সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে। তবে রাহিন, তাসফিয়া, নিশাত,মারিয়াদের জীবনে আর আসবে না এমন সময়। ডাকতে পারবে না বাবা বলে। মন চাইলেও পারবে না বাবার বুকে শুয়ে মাথার চুলগুলো টেনে দিতে। বাবার আবির মাখা স্পর্ষ্পের অধিকার কেড়ে নিয়েছে ঘাতক কাভার্ডভ্যান। তাদের বাবা এখন কেবলই ছবি,মাটির দেশের বাসিন্দা।

বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাত তখন প্রায় সাড়ে ১০টা। মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় ফিলিং স্টেশন থেকে তেল নিয়ে চট্টগ্রামমুখী একটি লরি (চট্টমেট্টো ঢ ৮১২২৪৬) বাম দিক থেকে হঠাৎ ডান দিকে উঠে যায়। এসময় পেছন থেকে আসা জোনাকি পরিবহনের (লক্ষীপুর ব ১১০০২০) একটি বাস লরির পেছনে ধাক্কা দিলে লরির গ্লাস ভেঙে যায়। আর এই নিয়ে দুই গাড়ির চালকের মধ্যে লাগে দ্বন্ধ। চলন্ত গাড়িতে কথার লড়াইয়ে একে অপরকে গায়েল করতে না পেরে মনসতাত্বিক প্রশান্তি পেতে গড়ি থামিয়ে দুই চালক লেগে যান চরম বাকযুদ্ধে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশ । ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। স্থানীয় চৈতন্যের হাট এলাকার সিএনজি অটোরিকশা স্টপেজ থেকে আসেন ৫-৬ জন অটোরিকশা চালক।

এক দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে এবার সংগঠিত হয় আরও একটি দুর্ঘটনা। পেছন থেকে আসা বেপরোয়া গতির মিনি কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্টো ন ১৫-১০৭৭) ঘটনাস্থলে উপস্থিত সিএনজি অটোরিকশা চালক ও হাইওয়ে পুলিশকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৪ জন নিহত হন। আহত হন পুলিশসহ আরও ৫ জন। যাদের ভিড়ে ছিলেন রাহিন, তাসফিয়া, নিশাত,মারিয়াদের বাবা শেখ ফরিদ ও শেখ সুমনও। তারা মিরসরাই সদর ইউনিয়নের গড়িয়াইশ গ্রামের শামসুদ্দীনের ছেলে। এতে নিহত অপর দুইজন হলেন উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মো. হারুনের ছেলে মেহেদী হাসান (২২) এবং পূর্ব রায়পুর এলাকার আবুল কাশেম (৬০)।

বাবা বলে ডাকার কেউ রইলো না ওদের! 1

এইদিকে সড়ক দুর্ঘটনার খবরে মহুর্ত্বে উপজেলা জুড়ে সৃষ্টি হয় শোকের মাতম। নিহতের বাড়িতে নিমিষেই নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বামী -সন্তান-বাবা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন স্বজনরা। কান্নার রোলে ভারী হয়ে যায় পরিবেশ।

বাবা হারা চার নাতি-নাতনীদের জড়িয়ে কান্নার বিলাপ যেন থামছেই না নিহত দুই সহদোরের বাবা শামসুদ্দিনের। কান্না বিজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, আমার তিন ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে শেখ ফরিদ বড়, শেখ সুমন মেঝ এবং ছোট ছেলে লিটন। তারা তিনজনই পরিবার পরিচালনা করতে আমার পেশাকে বেচে নিয়েছিল। তাই ভাড়ায় সিএনজি চালাতো । কিন্ত এখন কি হবে আমার। আমি এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে কি জবাব দিবো?

এইদিকে নির্ঘুম রাতের পর সকালেও থামেনি নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে নিহত ২ সহোদর শেখ ফরিদ (২৬) ও শেখ সুমনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের আহাজারিতে গড়িয়াইস এলাকায় এক শোকাবহ অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো সান্তনাতেই স্বজনদের আহাজারি থামছে না। নিহত শেখ ফরিদের শেখ রাহিন (২), তাসফিয়া (৪) এবং নিহত শেখ সুমনের নিশাত (৭), মারিয়া (৪) নামের শিশু সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে নিশাত বাবা হারানোর বিষয় আন্দাজ করতে পালেও বাকিরা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি কি হয়েছে তাদের বাবার সাথে । তারা এখনো বিশ্বাস করে রাত হলে চকলেট-চিপস নিয়ে ঘরে ফিরবে বাবা।

অনেক কষ্ট করে লোন নিয়ে সিএনজি অটোরিক্সাটি কিনেন উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের মেহেদী। তবে সেই কিস্তি শেষ করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।একই ইউনিয়নের পূর্ব রায়পুর এলাকার নিহত আবুল কাশেম (৬০) বাড়িতেও গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী সন্তান ও বোনেরা আহাজারির চিত্র। নানাভাবে সান্তনা দিয়েও কান্না থামাতে পারছেন না প্রতিবেশীরা।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নিহত ৪ জনের জানাজা শেষে তাদের পরিবারিক গোরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশের এএসআই মো. মোস্তফা কামাল (৪৫), কনস্টেবল জাকির হোসেন (৪০),আব্দুল আউয়াল (৫০) রফিক (২৫), শাহ আলী (২৬)।

এ বিষয়ে জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, দুর্ঘটনায় আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়িগুলো জব্দ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন পার হলেই ঘটে নতুন নতুন দুর্ঘটনা। আর এতে হারাতে হয় প্রিয়জনদের। আর এসব দুর্ঘটনা জনমনে বাড়িয়ে দিচ্ছে আতঙ্ক। তাই এসব দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী ।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।