আত্মসমালোচনা করার মতো আত্মবিশ্বাস ও সমালোচনা সহ্য করার সংস্কৃতি তৈরি হোক

সমালোচনাকারী মানে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ নয়। সমালোচনাকারী হতে পারে একজন বিশুদ্ধ পরামর্শক। সমালোচনা করতেও যোগ্যতা লাগে। তার সেই অন্তদৃষ্ট, সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষমতা থাকতে হয়।যিনি বস্তনিষ্ঠ সমালোচনা করবেন তারও সে মানের পড়াশোনা ও যোগ্যতা লাগবে।সমালোচনা হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক,গঠনমূলক। সমালোচনা করতে যে যোগ্যতা লাগে তা নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন -সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগেনা, সমালোচিত হতে যোগ্যতা লাগে।শুধু যে খারাপ কাজের সমালোচনা হয় তা নয়,ভালো কাজেরও সমালোচনা হয়।

শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক বলেন, আপনি যদি কোন ভালো কাজ করেন তাহলে লোকে আপনার সমালোচনা করবেই। আম গাছে আম ধরে বলেই লোকে ঢিল ছোঁড়ে। ফজলি আম গাছে আরও বেশি ঢিল ছোঁড়ে। শেওড়া গাছে কেউ ভুলেও ঢিল ছোঁড়ে না।

কথাগুলো এজন্য বললাম যে,মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি থাকলে তা ধরিয়ে দিতে। সরকারের সমালোচনা করতে,প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে।

যদিও সরকারের সমালোচনা করার মত এখনও সময় হয়নি।তবুও এ জাতীয় বক্তব্য – তাঁর অসম সৎ সাহস ও সততার ইংগীত বহন করে।আমিও মনে করি সরকারকে সমালোচনা শোনার সাহস রাখতে হবে। সমালোচনা থেকে শেখা এবং জানার স্পিরিট রাখতে হবে।সমালোচনা সরকারকে শুদ্ধ করে,সচেতন করে,সরকারের পথ চলাকে সুগম করে।

এজন্য সরকারকে দেশের মানুষের সমালোচনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা অনুগ্রহ নয় বরং সরকারকে অধিকার হিসেবে অন্যদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সরকারের কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে বিশেষজ্ঞ, অংশীজন এবং গণমাধ্যমের জোরালো অবস্থান, বিকল্প পরামর্শ এবং ভিন্নমত গ্রহণ করতে হবে। সমালোচনাকারীকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে অভিহিত করা হলে সমালোচনার দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।

জ্ঞানগর্ভ ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাকে অবজ্ঞাভরে দূরে সরিয়ে না রেখে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা উচিত। সরকার যত সমালোচনাকে গ্রহণ করবেন কঠোর জবাবদিহির আওতায় থাকবেন,ততোই সরকারের জন্য মঙ্গল। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে কীভাবে তার দেশের পার্লামেন্ট ও নিজের দল জবাবদিহির আওতায় এনেছে।

অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের কাছে জনগণের কিছু প্রত্যাশা আছে।যেমন, দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার—এরকম অনেক প্রত্যাশার কথাই উচ্চারিত হয়েছে নানা কণ্ঠে।কিন্ত এই চাহিদাগুলো যে একমাসেই পূরণ হয়ে যাবে, তেমনও কেউ হয়তো দাবি করবেন না কিংবা দাবী করাটাও অমূলক।সময়ের পরিক্রমায় বুঝা যাবে কতোটা কী হবে।বিষয়টা অনেকটা নির্ভর করবে – সরকারের কাজের স্বচ্ছতা, ইনটেনশন ও রাজনৈতিক দল গুলোর ধৈর্য্যের উপর।

এটা অনস্বীকার্য যে, সমালোচনা শুনতে কারো ভালো লাগে না। আর এ কারণেই বোধহয় সমালোচকদের প্রতি একটা বিরক্তি, রাগ মনে থেকেই যায়।মেধাবীরা মনে ক্ষোভ পুষে না রেখে সমালোচককে ধন্যবাদ জানান সঠিক পথ দেখানোর জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ার সমালোচনা মানে সাধারণ মানুষের পারচেপশন। জনগণ থেকে নেতিবাচক ফিডব্যাক পাওয়ার পর কিন্তু চটপট একটা ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন’ তৈরি করা যায়।আক্রমণাত্মক আলোচনাকে ইতিবাচক মোড় দেয়ার জন্য এটা খুব কার্যকর উপায়।

আমার ব্যাক্তিগত ধারনা, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক সচেতন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতি অনেক মনোযোগী যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে- সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে যারা পত্রিকায় লিখতে পারেনা তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে।

বুঝে হোক, আর না বুঝেই হোক- একমাত্র ‘বাংলাদেশ’ যেখানে প্রতিটি মানুষের মতামত প্রকাশ করার, নিজের বিচার-বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আমিও ব্যক্তিগতভাবে অধিকাংশ সমালোচনাকে ইতিবাচক বলেই মনে করি,বিশেষ করে যেগুলো বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা।সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সমালোচনার গুরুত্ব রয়েছে।কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন- ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যার ঘটনা, দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপি, ওসি, ওসি তদন্তসহ কতিপয় সংবাদকর্মীর পক্ষপাতদুষ্ট কার্যক্রমকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইতিবাচকভাবে নেয়নি,সমালোচনার ঝড় ওঠেছে।বরগুনার নয়ন বন্ড কর্তৃক রিফাত হত্যার ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামালোচনা, প্রতিবাদসহ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আরেকটি ইতিবাচক পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে।প্রশাসন তৎপর হয়েছে। গণমাধ্যম সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশ করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনার সূত্রপাত অনুসন্ধান করে দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরেছে।আবার কতিপয় গণমাধ্যম আছে যারা হয়তো ভুলে নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই বিতর্ক সৃষ্টি করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচার জন্ম দিয়ে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এর “সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করলে অপরাধ হবে না” এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাগোগ মাধ্যমে তাঁকে তুলোধুনো করা হয়েছে।একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় এ্যাম্বুল্যান্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অনেকে ওই যুগ্ম সচিবের পারিবারিক ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে তার ছেলেমেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছে, ‘তিতাসের বাবা-মা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, ঠিক তেমনি এই ভিআইপির এমন ক্ষতি করে কি হিসাব সমান সমান করা যায় না।’ আমি মনে করি, আমাদের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে। ব্যক্তির অপরাধ পরিবারকে জড়ানো মানে ওই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা। যেখানেই অসঙ্গতি সেখানেই আমাদের মতামতসহ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সঠিক পথের আহ্বান থাকতে পারে।
তাই আমরা গুজব না ছড়িয়ে ইতিবাচক সমালোচনা, সময় উপযোগী আলোচনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্ট্যাটাস-ছবি পোস্ট করবো,তাতেই সকলের মঙ্গল।তথ্য নির্ভর লেখাতে লেখকের ব্যক্তিত্বও ফুটে ওঠে।অন্যরাও তার মূল্যবোধ,ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে জাজ করতে পারে।
আমি মনে করি, আমাদের সবাইকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তথ্যনির্ভর আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, অন্যের ক্ষতি চাওয়া, অপমান-অপদস্ত করা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যার যতটুকু সম্মান তা প্রদান করাই আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং মনুষ্যত্বের প্রকাশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হতে পারে মানুষের কল্যাণে, জনসাধারণের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সর্বোপরি শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে। অন্যদিকে মিথ্যা-গুজবের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে আমাদের সবাইকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরাই হোক প্রকৃত সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।

কথা হচ্ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা ও পরামর্শ প্রসঙ্গে। কাজ করতে গেলেই ভালো কাজের পাশাপাশি কিছু ভুল হয় কিংবা হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে কাজে ভুল মানেই বিরূপ সমালোচনা। কখনো তা রূপ নেয় ব্যক্তিগত আক্রমণ, কখনো বা নীরব ভত্‍সনায়।

আত্মবিশ্বাসী লোকদের কাজের ফিডব্যাক যত নেতিবাচকই হোক না কেন, সেই বাধা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।বুদ্ধিদীপ্ত মানুষেরা সমালোচনাকে চেয়ে নেয়,যাতে সে তার কাজের ভুলগুলো কি সেটা বুঝতে পারে,পাবলিক পারচেপশন বুঝতে পারে।হয়তো মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সেজন্যই সরকারের সমালোচনা করতে,সরকারকে পরামর্শ দিতে বলেছেন।

সে তাগিদ থেকেই আমিও কিছু সমালোচনা লিখার ও পরামর্শ দেয়ার তাগিদ অনুভব করছি।তবে এ কথাও ঠিক যে,সরকারের বয়স মাত্র এক মাস কয়েক দিন। এত অল্প সময়ের হিসাব-নিকাশ নেওয়া অযৌক্তিক তো বটেই, রীতিমতো অসম্ভব একটা ব্যাপার।

প্রথমেই বলতে চাই সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের বেশকিছু দৃশ্যমান ভালো কাজ ছিল,যেমন: ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন,পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিজান,পাশাপাশি ভয়ানক দৃষ্টিকটু ছিল – মব জাস্টিস,শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো,শিক্ষককে গাছের সাথে বেঁধে রাখা,জোর করে পদত্যাগ করানো ইত্যাদি।ধরে নিলাম শিক্ষক ভুল করেছেন – সেজন্যতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছিল। এছাড়াও দেখলাম উচ্চ আদালত চত্বরে সাবেক মন্ত্রীকে আদালতে তুলতে গেলে তাদের ওপর জুতা-স্যান্ডেল পচা ডিমের বৃষ্টি ঝড়ছে। সাবেক বিচারপতিকে মারতে উদ্ধত হওয়া, তাকে আহত করা, অণ্ডকোষ ক্ষত করা কোনো সভ্য দেশের কৃষ্টি হতে পারে না।অপরাধীর জন্য তো বিচার আছে।এমন নয় যে,এখনও বিচারিক আদালত বিগত সরকার দ্ধারা পরিচালিত।

এরপর বিপ্লবকে পুঁজি করে একশ্রেণীর লোকেরা দখল,চাঁদাবাজি,খুন খারাপি, ও টেন্ডারবাজি শুরু করে।অনেকটা ক্ষুদার্ত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা প্রাথমিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। জনগণ এর কোনোটাকেই ভালোভাবে নেয়নি।

এর আগে গণভবনে লুটপাট,সংসদ ভবনে লুটপাট, ৩২ নাম্বারে অগ্নিসংযোগ, থানায় অগ্নিসংযোগ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল ও খুন খারাপি যা হয়েছে সেগুলো অন্তর্বর্তি সরকার গঠনের আগেই হয়েছে।এ দায় অন্তবর্তী সরকারের নয়।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে,একটি বিপ্লব ঘটিয়ে যারা সফল হলেন, সুন্দর আগামীর জন্য সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে চাইলে তাদের এখন আরও বেশি পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। প্রতিটি কাজে ও কথায় পরিশীলিত, সুসংগঠিত, শৃঙ্খলিত ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এই উত্তাল সময়ে লক্ষ রাখতে হবে, তারুণ্য যেন কোনোভাবেই পথ না হারায়। এখন তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছে গোটা দেশ।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। এতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সফর রাজ হোসেন (সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব), বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
উদ্যোগটা ভালো।ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে কারও কারও বিতর্ক থাকলেও কাজটা ভালো হলেই হলো।কিন্তু একটা বিষয়ে আমার সংশয় জেগেছে, সেটা হলো – পার্লামেন্ট ছাড়া সাংবিধানিক সংস্কার সম্ভব কিনা? সেজন্য কিছু সংস্কারের দায়িত্ব আগামীদিনের নির্বাচিত সরকারের জন্য রাখাই ভালো।যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততোই উত্তম।নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত দলকে দ্রুততম সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই সরকারের জন্য ভালো হবে বলে মনে করি।তবেনির্বাচনটা কীভাবে হবে—কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের দায়-দায়িত্ব কেমন হবে, প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা কার কাছে কীভাবে হবে, প্রেসিডেন্ট কেবলই একটা রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে টিকে থাকবে নাকি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থাকবেন—এসব বিষয়ের সুরাহাও প্রত্যাশা করে সচেতন মানুষ।
এছাড়াও ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কার এর জন্য একটা কমিশন গঠন করলে অধিকতর ভালো হতো বলে মনে করি।

ভালো উদ্যোগ
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা একটি বড় পদক্ষেপ বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। এ ছাড়া ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলারের দাম নির্ধারণের নমনীয়তাও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ভালো উদ্যোগ।যোগ্য লোকদের অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টার মতো পদে বসানো হয়েছে।মাননীয় অর্থ উপদেষ্টাকে সত্যিকার অর্থেই দেশের আর্থিক খাতের বিবেক কিংবা আর্থিক খাতের বাতিঘর বলা যায় ।অর্থনীতির যে সকল ‘গেম চেঞ্জার’,অগ্রনায়ক, পথরচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা রয়েছেন,তাদের মধ্যে তিনিও একজন বলে মনে করি।
আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান পদক্ষেপ হলো এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া।মাফিয়াদের একটা দুষ্টচক্রকে এ্যারেস্ট করাটাও ছিল ভালো উদ্যোগ।

কিছু পরামর্শ
বিগত সরকারের সময়কাল থেকেই সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই তলানিতে।সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ।ডলার–সংকট এখনো চলমান।সব পণ্য ও সেবার দাম হু হু করে বাড়ছে।
ব্যাংক খাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছে।অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে।ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, সেটা থেকে উত্তোরণের জন্য দ্রুত ব্যাংক কমিশন গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক সংস্কারের জন্য করণীয় ঠিক করতে হবে।ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান ব্যাধিগুলো দূর করতে হবে। কেন না -ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড।

এ ছাড়াও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করাও জরুরী।এ জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। আমি ব্যক্তগতভাবে মনে করি -অর্থনীতির স্বাস্থ্য খারাপ হলে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যও খারাপ হবে।

এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। সেদিন দেখলাম উপসচিবদের জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন নিয়েও সচিবালয়ে হট্টগোল হয়েছে,যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লেগেছে।মনে হয়েছে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। এছাড়াও শিল্প খাতে, বিশেষ তৈরি পোশাক খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাজারঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। চাঁদা নেওয়ার খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। তাই দ্রুত কিছু প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন

যা করতে হবে
* প্রশাসনব্যবস্থার স্থিতিশীল এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা,জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা,চাঁদাবাজি বন্ধ করা,মব জাস্টিস বন্ধ করা।
* ব্যাংক খাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য অন্তত একটা টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরী।

* মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা হতে হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার দিতে হবে।নিশ্চিত করতে হবে মাথাপিছু খাদ্যনিরাপত্তা।এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বন্দরগুলোকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখা ও বন্দরকে দূর্নীতিমুক্ত করা।

*আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদের ঋণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা করা।অর্থায়ন আসার ক্ষেত্রে বিগত সরকার যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো চলমান রাখা।

* সবিচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের
পরিকল্পনা, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এবং নেতৃত্বের সক্ষমতা।
* যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত কর।কিছু সংস্কার নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।কারণ রাষ্ট্রের প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচিত সরকারের দায়বদ্ধতা এক নয়।

* আমলাদের সততা ও নিষ্ঠা, বিধি-বিধানের যথাযথ পরিপালন, নিরপেক্ষতা সরকারের নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনে বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ প্রদান নিশ্চীত করা।

* দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় পদোন্নতি বন্ধ করা।সততা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নীতি বজায় রেখে মেধা, যোগ্যতার মূল্যায়ন, গ্রেডেশন,এ সি আর ও পারফরমেন্স এর ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া।
ব্যক্তিগত মতাদর্শ যাই থাকুক না কেন বাস্তবে বহু মেধাবী, সৎ, পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও মেধাবী আমলা রয়েছে।আমলাতন্ত্রে নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার অনুশীলন চালু হলে তাঁরা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র চর্চায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

* সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাসস, বিটিভি ও রেডিও এর স্বায়ত্তশাসন দেয়া প্রয়োজন। যাতে তারা স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে।ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল করা যেতে পারে।ন্য্যয় বিচারের স্বার্থে জুডিশিয়ারির ইনডিপেনডেন্সও প্রয়োজন।

* অতি দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে ছাত্রদের ক্লাসে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া।

* সরকারের একটা রোড ম্যাপ থাকা উচিত।তাহলে জনগণ স্বস্তি পাবে।এবং রোড ম্যাপে কোনো ভুল থাকলে ইনট্যালেকচ্যুয়ালেরা সরকারকে ইতিবাচক পরামর্শ দিতে পারবে।কারণ সরকারের বাইরেও অনেক নিভৃতচারী ইন্টেলেকচ্যুয়াল আছে।যারা কোনো প্রকার সন্মানী ছাড়া,রাষ্ট্রের স্বার্থে বিভন্ন কল লিখে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারবে।
অতিসত্বর এগুলোর সমাধান না এলে স্বল্প মেয়াদে সংকট তীব্রতর হতে পারে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।