ট্রেনের অনলাইন টিকিটে ভিড় কমলেও বেড়েছে ‘ডিজিটাল জটিলতা’

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির হাত থেকে রক্ষা করতে চলতি বছরের মার্চ থেকে অনলাইন টিকিটের ব্যবস্থা করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’— এই নিয়ম মোতাবেক জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেই শুধু অনলাইনে টিকিট কাটতে পারবেন যাত্রীরা। এতে যার নামে টিকিট কাটা হবে তাকেই ট্রেনে যাত্রা করতে হবে। নতুন এই নিয়ম চালু হওয়ায় ট্রেন স্টেশনের কাউন্টারগুলোতে এখন আগের মতো ভিড় না হলেও ‘সিস্টেম জটিলতায়’ পড়ে ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন অনেক যাত্রী। অনলাইন সিস্টেমের সাথে অব্যস্ত না থাকা, রেজিস্ট্রেশন জটিলতা, পূর্বে রেজিস্ট্রেশন করা থাকায় নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করতে না পারা, সার্ভার ডাউনসহ নানান সমস্যা যেন ট্রেন যাত্রা অনিশ্চিত করে তুলেছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের। এছাড়া অনলাইনে জটিলতার কারণে অনেকে ট্রেনের পরিবর্তে বিকল্প যানবাহন বেচে নেওয়ায় অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে অনেক টিকিট।

জানা গেছে, নতুন নিয়মে শুধু অনলাইন নয়, কাউন্টার থেকেও ট্রেনের টিকিট কিনতে নিবন্ধন করতে হচ্ছে। খুলতে হচ্ছে অ্যাকাউন্ট। কাউন্টার, অনলাইন ও অ্যাপের মাধ্যমে তা করা যাচ্ছে। ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে থাকা যাত্রীরা সাধারণত মোবাইল ফোন থেকে এসএমএসের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন। আগে থেকে যাদের রেলের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা আছে তাদের সাইন-ইন করে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টিকেট কাটতে হচ্ছে। আর যাদের আগে থেকে নিবন্ধন নেই, একেবারেই নতুন, তাদের প্রথমে ওয়েবসাইট ভিজিট করে সাইনআপ করে জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোডের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে টিকেট কাটতে হচ্ছে।

যাত্রীরা বলছেন, নতুন এই প্রক্রিয়া ফলে আগের মতো লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হচ্ছে না। তবে ডিজিটাল ব্যবস্থার সাথে অব্যস্থ না হওয়া এবং নতুন এ নিয়মের কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন অনেকে। টিকিট কাটতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়ে অনেকে সমাধান খুঁজছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সরজমিনে যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ যাত্রী টিকিট কাটার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। অনেকে আগে মা-বাবার টিকিট নিজে করে দিলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছেনা। কেউ কেউ আবার স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে জানেনা বিধায় টিকিট কাটতে সমস্যায় পড়ছেন। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যিায় পড়ছেন পূর্বে অ্যাকাউন্ট করা ব্যাক্তিরা। আগে অ্যাকাউন্ট থাকায় নতুন করে আর অ্যাকাউন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার নতুন ফোন নম্বর ব্যবহারের সুযোগও নেই। যার ফলে পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়ে, মোবাইল হারিয়ে বা সিম পরিবর্তন করে এখন ট্রেনে টিকিট কাটতে পারছেন না তারা। যার ফলে ঈদের আগ মুহূর্তে এসে বাড়ি ফেরা নিয়ে বাড়তি টেনশনে পড়তে হচ্ছে তাদের। এছাড়া একসাথে অনেক যাত্রী টিকিটের জন্য সার্ভারে প্রবেশ করায় সার্ভার স্লো হয়ে যাওয়া টিকিট না পাওয়াসহ যাত্রীদের বিস্তর অভিযোগ প্রশ্নের মুখোমুখী করছে নতুন এই পদ্ধতিকে।

এদিকে সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া প্রায় নিয়মিতই একের পর এক সিদ্ধান্ত দেয়া ও পরিবর্তনের কারণে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা। এ কারণে আসন্ন ঈদ-পূর্ব রেলের টিকিট এখনো অবিক্রীত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। ঈদের ১১ দিন (যাত্রার দিনসহ) আগে অগ্রিম টিকিট বিক্রি, কাউন্টারের পরিবর্তে শতভাগ অনলাইনে টিকিটের কারণে অনেকেই ট্রেনের পরিবর্তে বিকল্প বাহনের দিকেও ঝুঁকছে।

রেলের টিকিট বিক্রির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে দেখা যায় (সোমবার রাতে ৮টা), টিকিট কেনার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছে ১২ লাখ ১৮ হাজার ১৪৪ জন। ১২ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত রেলের টিকিট অবিক্রীত রয়েছে মোট ৯ লাখ ৪২ হাজার ৭২৩টি। এর মধ্যে ২১ এপ্রিলের টিকিট অবিক্রীত রয়েছে ৯৪ হাজার ৩৪৮টি, ২০ এপ্রিল ৮৮ হাজার ৪১৯, ১৯ এপ্রিল ৮৯ হাজার ৬৮৯, ১৮ এপ্রিল ৮৭ হাজার ৩৮৮, ১৭ এপ্রিল ৯৪ হাজার ৩০৭, ১৬ এপ্রিল ১ লাখ ১৩ হাজার ২০৬, ১৫ এপ্রিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫৯, ১৪ এপ্রিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪১২, ১৩ এপ্রিল ৭৩ হাজার ৬০২ ও ১২ এপ্রিলের টিকিট অবিক্রীত রয়েছে ৬৯ হাজার ২৯৩টি।

রেলের ট্রাফিক অপারেশন বিভাগের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রির সময়ে প্রতিদিন অনলাইনে টিকিট কেনার জন্য ওয়েবসাইট ও অ্যাপে হিট হয়েছে দুই-আড়াই কোটি বার। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির কারণে ডিজিটাল প্লাটফর্মে অনভ্যস্ত অনেকেই টিকিট কেনেনি বা টিকিট কিনতে সক্ষম হয়নি। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে শতভাগ টিকিট বিক্রির কারণে টিকিট কালোবাজারে বিক্রির প্রবণতা কমে এলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ কঠিন হয়ে গেছে বলে মনে করছেন রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের তথ্য বলছে, ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ বিক্রির কথা থাকলেও এ বছর অনেক টিকিটই অবিক্রীত থাকছে। ৭ এপ্রিল দেয়া ১৭ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি হয়েছে (সকাল ১০টা পর্যন্ত) ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ ৭ এপ্রিল সকাল ১০টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গন্তব্য অভিমুখী ১০টি আন্তঃনগর ট্রেনের ৫১ দশমিক ৫০ শতাংশ টিকিটই অবিক্রীত ছিল।

এছাড়া ৮ এপ্রিল অগ্রিম বিক্রি হওয়া ১৮ এপ্রিলের টিকিটের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেকটা একই চিত্র। ৮ এপ্রিল সকাল ১০টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের আন্তঃনগর ট্রেনের ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ টিকিট বিক্রি হলেও ৩৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ টিকিট অবিক্রীত ছিল। মূলত দেশের সার্বিক জনসংখ্যার তুলনায় মুষ্টিমেয় যাত্রী রেলওয়ের টিকিট সংগ্রহের জন্য রেজিস্ট্রেশন করায় ঈদযাত্রায় রেলের টিকিট বিক্রি কম হয়েছে বলে মনে করছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ঈদের অগ্রিম টিকিট অনলাইনে বিক্রির কারণে কালোবাজারি প্রতিরোধ ছাড়াও মানুষের ভোগান্তি কমেছে। রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে “টিকিট যার, ভ্রমণ তার” বাস্তবায়নের কারণে টিকিট ক্রয় কিছুটা জটিল হলেও একসময় মানুষ নতুন এ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে সব শ্রেণীর মানুষই এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এর পরও অনলাইনে টিকিট বিক্রি, রেজিস্ট্রেশনে ই-মেইলের ব্যবহারসংক্রান্ত যেসব সমস্যা আছে সেগুলো ঈদের পর সমাধান করা হবে। যাত্রার আগ মুহূর্তে অবিক্রীত টিকিটও বিক্রি হয়ে যাবে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।