নদভীর দাবি ‘সিক্স মার্ডার’—ওসিরা বললেন ‘নো মার্ডার’

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) সংসদীয় আসনের সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেছেন—৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন আসামি ধরছে না।
কিন্তু দুই থানার ওসিদের দাবী তথ্যটি সঠিক নয়। গত আড়াই মাসে সাতকানিয়ায় মাদক নিয়ে ঝগড়ার জেরে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছে।

২১ মার্চ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিক্স মার্ডারের দাবী করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন বিভিন্ন সময় আলোচনা থাকা সাবেক সাংসদ নদভী।

সংবাদ সম্মেলনের নদভী বলেন, নির্বাচনের আগে গত ২১ ডিসেম্বর আমার ওপর এবং আমার স্ত্রীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। নির্বাচনের পর আমার লোকজনের ওপর হামলা অব্যাহত আছে। বর্তমান এমপির লোকজনের অত্যাচারে আমার লোকজন বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অনেকেই আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আমি তাদের তিনবেলা খাওয়াচ্ছি। যাতে আমার লোকজন তাদের ঘর-বাড়িতে যেতে পারে, থাকতে পারে আমি সেই সমাধান চাচ্ছি।

নিজে ১০ বছর সংসদ সদস্য থাকার সময়ে সংসদীয় আসনকে শান্তির জনপদ দাবী করে তিনি গত আড়াই মাসে ‘৬টি মার্ডার’ হয়ে উল্লেখ করে আগামী উপজেলা নির্বাচনে ‘কয়টি মার্ডার হবে সেটি আল্লাহ জানেন’ বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন।

সাবেক সাংসদ নদভীর দাবী করা ৬টি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাতকানিয়া থানার ওসি প্রিটন সরকার বলেন, গত আড়াই মাসে ১টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মাদক নিয়ে। আমরা অভিযুক্ত সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছি। এর বাইরে কোনো হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা মামলা সাতাকানিয়া থানায় নেই।

লোহাগাড়া থানার ওসি রাশেদুল ইসলাম বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমাদের থানা এলাকায় কোনো হত্যাকাণ্ড নেই।

নদভী আরও দাবী করেন, জামায়াতের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি হওয়া সাতকানিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মোতালেবের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। যাতে রয়েছে ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসীসহ যেসব আলেমকে আমি সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আসতে দিইনি তাদের এখানে আনা হবে। চুক্তি অনুযায়ী জামায়াতের নেতাকর্মীরা মাঠে। এমনও হতে পারে—জামায়াত তাদের (সাংসদ মোতালেবদের) বলেছে তোমারা এমপি হও, আমরা উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান হবো।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে ড. আবু রেজা নদভী বলেন, টিআর কাবিখা নিয়ে অনিয়ম করতে চেয়েছেন মিনহাজ। আমি সুযোগ দিইনি বলে আমার বিরুদ্ধ বলেছেন। ‘বহুত হাইয়্যে, আর ন হাইয়্যে’ গোটা দেশ-দুনিয়া ভাইরাল করে দিয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি মানুষের জায়গা দখল করতে চান। আমিতে দিবো না। আমি একটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেলাম সেখানে তিনি সন্ত্রাসী জড়ো করেছেন। ‘তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে আসছে। অস্ত্র তো একটু লুকিয়ে রাখতে হয়, ওর লোক জনের লম্বা লম্বা অস্ত্র সব বাইরে।’
তিনি আরও বলেন, এ ধরণের বদহজমী মানুষ নিয়ে তো আমি টিকে থাকতে পারবো না। সেজন্য আমার এখান থেকে চলে গেছেন। সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আবছার চৌধুরীকে। তাকে সরিয়ে মিনহাজকে সভাপতি করা হয়েছে। মিনহাজ সভাপতি হওয়ার পর জামায়াত নেতা সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীর ব্যানার, পেস্টুন টাঙানো হয়েছে কলেজে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজি ও নিউক্লিয়ার ইমেজিং বিভাগের অধ্যাপক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘মনগড়া তথ্যে সংবাদ সম্মেলন করলেন নদভী।’ দুই মাসে এতগুলো মার্ডার হলে দেশ তো তোলপাড় হয়ে যেতো। মাদক নিয়ে একটা মার্ডার হয়েছে, পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছে।
আর আমি ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলাম। আমি যখন বিএমএ নির্বাচন নিয়ে শহরে ব্যস্ত তখন তিনি কলেজের অধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেনের বাসায় গিয়ে জোরপূর্বক কিছু কাগজে স্বাক্ষর এনেছেন। অবৈধভাবে নুরুল আবছার সাহেবকে সভাপতি বানিয়েছেন। কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চারজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। গত ২৩ জানুয়ারি আবার সভাপতি হওয়ার পর অবৈধ নিয়োগ পাওয়া সেই চার জনের চাকুরী চলে গেছে। আর আমাদের রক্ত মুজিবীয় রক্ত। আমি সভাপতি হওয়ার পর জামায়াত পুনর্বাসিত হওয়াটা কাল্পনীক গালগপ্প।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা ডা. মিনহাজ আরও বলেন, ২০১৪ সালে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব সাতকানিয়ার কৃতি সন্তান মরহুম মেজর জেনারেল আবেদীন সাহেবের মাধ্যমে মনোনয়ন নেন। চট্টগ্রামের কোনো নেতা তার নির্বাচনী এজেন্ট হতে রাজী হননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সামরিক সচিব জয়নুল সাহেব আর আমি ২৮ মিনিট একান্তে কথা বলেছি। তারপর আমি নদভীর নির্বাচনী এজেন্ট হই। কিন্তু এমপি হওয়ার পর দলের নেতাকর্মীদের চেয়ে তার কাছে তার বউ, ভাতিজা, শ্যালকসহ জামায়াতের বিভিন্ন পদের লোকজন অগ্রাধিকার পায়। ওই পরিস্থিতিতে তার সঙ্গে থাকা সম্ভব ছিল না। আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে এসছি, জামায়াতি পরিবারের লুটপাটের সহযোগী থাকতে পারিনি।

এমএম মোতালেব এমপি হওয়ার দুই মাসের মাথায় সাতকানিয়ার অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হয়েছে, ফসলী জমির টপসয়েল কাটা বন্ধ হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ গ্যাস বিক্রি বন্ধ হয়েছে। আর কেরানীহাট মাদ্রাসার মার্কেট নির্মান করতে চেয়েছেন তৎকালীন সাংসদ নদভী। আমি তা হতে দিই নাই।

নদভীর ক্ষোভের আগুনে জ্বলা কে এই মিনহাজ?
ডা. মিনহাজুর রহমান সাতকানিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম রামপুর এলাকার মরহুম মুজিবুর রহমানের সন্তান। মরহুম মুজিবুর রহমান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক ছিলেন। ডা. মিনহাজ চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি, চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিষয়ে এম.ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ডা. মিনহাজ বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রেজিস্টার এবং ইউএসটিসির সাবেক প্রভাষক হিসেবে প্রশাসনিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও সাতকানিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি পদে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি সাতকানিয়ার কেরানিহাট জামেউল উলুম ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা গভর্নিং বডিরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এম এ মোতালেব সিএআইপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে ড. নদভী নিজেকে আন্তর্জাতিক স্কলার দাবী করে বলেন, বিদেশে অংশ নেয়া এক একটা সম্মেলনে তিনি ৫ হাজার, ১০ হাজার ডলার সম্মানী পান। এটিই তাঁর মূল আয়।
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) চেয়ার হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২০২১ সালে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে আওয়ামী লীগের যাদের আমি আইআইইউসিতে নিয়ে গেছি তারা আমাকে সরানোর ষড়যন্ত্র করছেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।