নাহার এগ্রো—টুটুলের ঈদ সালামির ৯শ টাকার পুঁজি থেকে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান

বাবার চাকুরির সুবাদে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার সরকারি বাংলোতে বসবাস করতেন রাকিবুর রহমান টুটুল। শহরে বসবাস করেও গ্রামীণ বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পুকুর ভরা মাছ, হালচাষ, গবাদি পশু ও হাস-মুরগির প্রতি ছিলো অন্যরকম আগ্রহ। আর তাই সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন ফেনী জেলার গ্রামের বাড়িতে। ক্ষেতে খামারে চষে বেড়িয়ে জানতে চাইতেন কৃষির গল্প। তবে সেই গল্প যেন তার ক্ষুধা মেটাতে পারেনি। আর তাইতো নিজেই শুরু করে দেন মুরগি লালন পালন।

ইট পাথরে ঘেরা নগরীর পাহাড়তলীতে অবস্থিত সরকারি মুরগির ফার্মে একসাথে শত শত মুরগির বিচরণ টুটুলকে আকৃষ্ট করে। সেই সাথে নানান প্রশ্নের জটলাও খুলে দেয়। সকল সংশয় উড়িয়ে ঈদ সালামির জমানো ৯০০ টাকা দিয়ে ফাউমি জাতের ৩০০ বাচ্চা বাসায় নিয়ে আসেন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া রাকিবুর রহমান টুটুল। বাসার সামনে টিন দিয়ে ব্রুডিং তৈরি করে সেখানেই মুরগিগুলো পরিচর্যা শুরু হয়। ২০ সপ্তাহ পর এসব মুরগি থেকে প্রতিদিন ২৮০ থেকে ২৯০টি ডিম আসা শুরু করলো। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আশেপাশের লোকজনের কাছে শুরু হলো ডিম বিক্রি। শুরু হয় ‘নাহার এগ্রো‘ নামে বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের অনানুষ্ঠানিক পথচলা।

১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার রেলওয়ের সরকারি বাসার প্রাঙ্গণে শুরু হওয়া সেই উদ্যোগ আজ অনেক বড়। তিন যুগের ব্যবধানে রাকিবুর রহমান টুটুলের এই উদ্যোগ রূপ নিয়েছে এগ্রো খাতে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপে। তার মা সামসুন নাহারের নামে প্রতিষ্ঠিত নাহার এগ্রো গ্রুপের অধীনে পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিড মিল সহ নানা খাতে রয়েছে ১০টি কোম্পানি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ৩৫টি কারখানা। এসব কারখানায় সরাসরি কাজ করেন ৪ হাজারের অধিক লোক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজার পোল্ট্রি খামারীদের মুরগির বাচ্চা, খাদ্য সহ বিভিন্ন কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করছে শিল্প গ্রুপটি। নাহার এগ্রোর বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার ১০০০ কোটি টাকা।

মুরগি লালন পালনের সাথে ১৯৯১ সালে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি দুগ্ধজাত গরু ক্রয় করেন টুটুল। একই বছরে ৮৭ হাজার টাকায় আরও একটি গরু কেনেন। আশেপাশের এলাকায় লোকজনের কাছে বিক্রি করা হতো দুধ। চাহিদা বাড়ায় পরের বছর ১ লাখ ৪১ হাজার আরও একটি গরু ক্রয় করা হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাছুরসহ ১৭টি গরু হয় খামারে।

চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালে মারা যান টুটুলের পিতা মাহবুবুর রহমান। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে এই খাতে ব্যবসা বাড়াতে আরও উদ্যোগী হন টুটুল। পড়াশোনা, পরিবারের দেখাশুনার সাথে চলতে থাকে ব্যবসায়ীক কাজ। নিজের প্রচেষ্টার সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন ব্যবসায়ের পরিধি। বিভিন্ন সময় বাধা নুইয়ে দিতে চেয়েছে এই উদ্যেগ। তবে মেধা, প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগী মনভোব টুটুলকে দমাতে পারেনি। সকল বাধা পেরিয়ে নাহার এগ্রো আজ তার জায়গা দখল করে নিয়েছে।

১৯৯৪ সালে নাহার ডেইরি, নাহার পোল্ট্রি, নাহার পোল্ট্রি ফিড নামে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন টুটুল। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের কুমিরাতে ৪২০০ বাচ্চা দিয়ে প্যারেন্ট স্টক (বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ডিম দেওয়া মুরগি) পালন করা শুরু করেন তিনি। ২০০২ সালে নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। এরপর মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একে একে গড়ে ওঠে কারখানা।

নাহার এগ্রো—টুটুলের ঈদ সালামির ৯শ টাকার পুঁজি থেকে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান 1

বর্তমানে নাহার এগ্রোর বিভিন্ন খামারে ব্রয়লার এবং লেয়ার পোল্ট্রি প্যারেন্ট স্টক মুরগি রয়েছে ১২ লাখ। এসব প্যারেন্ট স্টক মুরগির ডিম থেকে বিভিন্ন হ্যাচারীতে প্রতি সপ্তাহে ২২ থেকে ২৪ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ডেইরি খামারে দুগ্ধজাত, প্যাটেনিং সহ গরু আছে ১৭০০টি। প্রতিদিন ৫৫০০ থেকে ৬ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়।

মিরসরাই, সিরাজগঞ্জ, যশোরে ৪টি ফিড মিল রয়েছে নাহার এগ্রোর। প্রতি মাসে উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। নিজেদের খামার এবং বাজারজাতকরণের জন্য প্রতি মাসে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ফিডমিল উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ নিজেদের খামারে ব্যবহৃত হয়। বাকি ৮০ শতাংশ বাজারজাত করা হয়। নাহার এগ্রো মুরগির বাচ্চা, ফিড এবং অন্যান্য কারিগরি সহযোগিতা দেয় প্রায় ১০ হাজার পোল্ট্রি খামারিকে। ৫০০ থেকে ৫ হাজার মুরগির খামার রয়েছে এসব উদ্যোক্তাদের।

নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুল বলেন, দেশে প্রোটিন এবং আমিষের চাহিদা মেটানোর প্রয়াস থেকে ছোট থেকে আজকে আমাদের এই প্রতিষ্ঠান অনেক বড়। আমরা সব সময় চাই সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে আমাদের পশু-মুরগি লালন পালন করতে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচন এবং গুণাগুণ বৃদ্ধিতে কাজ করছে। আমাদের একাগ্রতা এবং কঠোর পরিশ্রম আজকে আমাদের এতদূর এগিয়ে এনেছে।

তিনি বলেন, সব কাজে চ্যালেঞ্জ থাকে। আমরা এখনও প্রতিদিন নানান সমস্যার মধ্যে পড়ি। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ের প্রক্রিয়া এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আছে; যেটা আমরা সময়ের সাথে অর্জন করেছি। আর এই আস্থা আমাদের ব্যবসায়কে সব সময় সাহায্য করে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের মানুষ কেবল গরু পালনের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু কাজ করার আরও অনেক জায়গা আছে। মাছ, ফল, ফসল এসব কিছুও সফলতা এনে দিতে পারে। দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী যদি পরিকল্পনামাফিক এসব কাজে জড়ায় তাহলে পরিবার, সমাজ তথা দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুল বর্তমানে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (২০১৭-২০২১) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া রাকিবুর রহমান ভাটিয়ারি গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব, চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড, শাহীন গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব সহ বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন।

নাহার এগ্রো—টুটুলের ঈদ সালামির ৯শ টাকার পুঁজি থেকে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান 2

রাকিবুর রহমান টুটুল ২০২১ সালে মিনিস্ট্রি অব ফিশারিজ এন্ড লাইভস্টক কর্তৃক ‘ডেইরি আইকন’, ‍২০২২ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই কর্তৃক ‘সেরা কৃষিক’, এবং ২০২২ সালে বেস্ট ক্যাটল ফার্ম কর্তৃক ‘এসিআই দীপ্ত কৃষি অ্যাওয়ার্ড’ পান। ডেইরি খাতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী টুটুলের হাতে উঠেছে অসংখ্য পদক, সম্মাননা। সর্বশেষ এসিআই দীপ্ত কৃষি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে নাহার এগ্রো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নাহার ডেইরি লিমিটেড। টুটুল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছ থেকে ‘ডেইরি আইকন ২০২১’ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: রকিবুর রহমান টুটুল।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।