সিআরবিতে কাওয়ালী জলসা, সুরে সুরে প্রশান্তির ছোঁয়া

পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। খানিকটা লালের আভায় মোড়ানো গৌধূলির আলো-আঁধারিও কেটে গেছে। ধীরে ধীরে ভিড় জমতে শুরু করে চট্টগ্রাম নগরীর সবুজে মোড়ানো সিআরবিতে। তারপর আঁধারের বুক চিরে বেজে ওঠে সুমধুর সুর। কাওয়ালীর সুরে সুরে চারদিকে বিরাজ করে এক প্রশান্তির আবহ।

শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবিতে অনুষ্ঠিত কাওয়ালী জলসায় ছিলো হাজার হাজার দর্শক-স্রোতার উপস্থিতি। দফ আর শিল্পীদের কোসারে যেন অন্য এক রূপ ধারন করে সুবজে ঢাকা সিআরবি।

মাহে রবিউল আউয়াল উদযাপন উপলক্ষে শানে মোস্তফা (স.) ও কাওয়ালী জলসার আয়োজন করেছে চট্টগ্রামের পারাবার সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ। মঞ্চে একের পর এক কাওয়ালী গান গান চট্টগ্রামের ইসলামী ঘরোয়ানা শিল্পগোষ্ঠী পারাবার, পানজেরী, দুর্নিবার ও দর্পণের শিল্পীরা।

দর্শক-স্রোতারা বলেন, কাওয়ালী গান আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এই গানের আসরে স্নিগ্ধতা বিরাজ করে। চারদিকে সবুজ গাছ-গাছালি তার মাঝে সুর এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

তারা বলেন, আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতায় যারা শহীদ হয়েছোন তাদের ঋণ আমরা শোধ করতে পারবো না। অন্তত ভালোবাসা দিয়ে, দেশীয় সংস্কৃতি, আমাদের বিশ্বাসের সংস্কৃতি,বাংলাদেশের মানুষের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা সেই ঋণ শোধ করতে চাই।

সিআরবিতে কাওয়ালী জলসা, সুরে সুরে প্রশান্তির ছোঁয়া 1

প্রসঙ্গত, আরবি ‘কাওল’-এর অর্থ হলো ‘কথা’, বিশেষত মহানবী (সা.) সম্পর্কিত। কাওয়াল শব্দের অর্থ, যে কথাগুলো (কাওল) প্রায়শই প্রতিধ্বনিত করে (গায়)। আর কাওয়ালি হলো কাওয়ালরা যা গায়। এর অর্থ এভাবেই দিয়েছেন টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ডিকশনারি অব অ্যারাবিকের সংকলক বিএ কোরেশি।

কাওয়ালী হলো ভারতীয় উপমহাদেশের সুফি ঘরানার গান ও সুরের উপস্থাপন, যা ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে আবর্তিত, বিশেষত খানকাহগুলো ঘিরে। এ গানের একেকটা আসরকে বলা হয় মাহফিল-এ-সামা। এর উদ্ভব মূলত অষ্টম শতাব্দীর পারস্যে। আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় সুফি মতবাদ ও দর্শনের।

দার্শনিক ভাবধারার শ্লোকে সাজানো দলগত সংগীত আয়োজন তৎকালীন সুফি চর্চার অন্তর্গত ছিল। আবু হামিদ আল গাজালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন এই শ্লোকগুলোর শ্রেষ্ঠ কবি। ফার্সি-হিন্দুস্তানি ঘরানার এই সংগীতের অন্যতম গজলের আঙ্গিক তারই আবিষ্কার।

একাদশ-দ্বাদশ শতকে ভারতে সুফিদের মূল আস্তানা মুলতান ও পাঞ্জাবকেন্দ্রিক হলেও ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে তা ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীর, বিহার, বাংলা আর দাক্ষিণাত্যে।

তাদের বয়ে আনা কাওয়ালী দিল্লিতে এসে পড়ে হজরত আমির খসরুর কাছে। চিশতিয়া সিলসিলার অন্যতম পুরুষ, দিল্লির নিজাম-উদ-দিন আউলিয়া (র.)-এর এই শিষ্য এই গানকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাকরণসম্মত রূপ দেন।

বঙ্গ এলাকায় কাওয়ালীর প্রচলন কে করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে ইতিহাস বলে, বাংলায় চিশতিয়া সিলসিলা ত্রয়োদশ-চতুর্দশ এমনকি তার আগেও বেশ প্রভাবশালী ছিল।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।