কিংবদন্তির গল্প হয়ে থাকবেন সাংবাদিক আহসানুল হুদা

হালে শহুরে সাংবাদিকতাকে আমরা যেভাবে বড় করে দেখি, আহছানুল হুদা সেই অর্থে বড় কেউ ছিলেন না। কিন্তু শহরতলীর আনোয়ারার প্রসঙ্গ এলে সেখানে নি:সন্দেহে উপরের দিকে থাকবেন আহছানুল হুদার নাম। তিনি শুধু সংবাদের ফেরিওয়ালা ছিলেন না, ছিলেন হাজারো মানুষের `বাতিঘর‘ , বিপদের ভরসাস্থল।

আহছানুল হুদা ছিলেন আনোয়ারা প্রেস ক্লাবের সফল সভাপতি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুই যুগেরও বেশি সময় আনোয়ারা প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে।

বর্তমান সময়ে সাংবাদিকরা যেখানে নিজেরাই নিজেদের পেশাকে পেছনের দিকে টানছেন, সেখানে প্রয়াত আহছানুল হুদা ছিলেন লোভ, টাকার নেশা, বিলাসিতার উর্ধ্বে উঠা অনন্য একজন। ইঞ্চি মাপা সততা ধরে রাখতে গিয়ে সারাজীবন অভাবে হাবুডুবু খেয়েছেন, তবুও এতটুকু আদর্শচ্যুত হননি। মৃত্যুর আগে এক বছরেরও বেশি সময় তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করেছেন। অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে ছিলেন।

জটিল রোগ হলেও আমরা ধরে নিয়েছিলাম মানুষের দোয়া আর ভালবাসায় ঠিকই ফিরবেন আহছান চাচা। কিন্তু আল্লাহ তার বান্দার ভাগ্য, জন্ম-মৃত্যু নির্ধারণ করে রাখেন। যেদিন তিনি দুনিয়া ছেড়ে যান, মনে হয়েছিল যেন পুরো আনোয়ারাবাসী কাঁদছে। এই কান্না ভালবাসার, একজন বিপদের বন্ধুকে হারানোর। কলমকে তিনি শুধু জীবিকার হাতিয়ার হিসাবে বেছে নেননি, তার কলমে লেখা হতো নির্যাতিত মানুষের কান্নার প্রতিচ্ছবি, অন্যায়ের প্রতিবাদ আর সাধারণ মানুষের সুখ দূ:খের কথা। তাইতো তাঁর সাংবাদিকতাকে আজো স্যালুট করে আনোয়ারার হাজারো মানুষ।

তাঁর মৃত্যুতে আনোরায়ারার সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার মৃত্যুতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মফস্বল সাংবাদিকতায় এক অনন্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করে গেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন আলো ছড়াবে আরও বহুদিন, বহু যুগ।

আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিনগুলোতে সৌভাগ্য হয়েছে আহছান চাচার কাছাকাছি থাকার। তার কাছে শিখেছে `সংবাদের সব উপাদান থাকলেও সব সংবাদই সংবাদ নয়‘ । যে সংবাদে মানুষের উপকার হবে না তা অক্ষরের জঞ্জাল ছাড়া কিছুই নয়। তিনি জীবনঘনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে ধারণ করেছিলেন।

আহছানুল হুদা ছিলেন সার্বক্ষণিক একজন সাংবাদিক। সংসার-সন্তান থাকলেও তিনি আসলে আমৃত্যু ঘর করেছেন সাংবাদিকতার সাথে। আনোয়ারার সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বয়সী মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু কম বয়সীরা কখনোই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারত না। ‘সাংবাদিকতাকে মেরে ফেলছি আমরা। সাংবাদিকতা নেই দেশে। টাকার পেছনে ছুটলে সাংবাদিকতা হয় না’- এভাবেই বলতেন আহছান চাচা। সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করা আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সঙ্গে এটাও বলতেন, চেষ্টা থাকলে সব আমলেই সাংবাদিকতা করা যায়।

আহছান চাচার আরেকটা বড় গুণ ছিল চাপ সামাল দেওয়া। যত চাপ, সব কাঁধে তুলে নিতেন। আমরা যাঁরা বয়সে ছোট ছিলাম, কখনও চাপ বুঝতাম না।

সাংবাদিক আহছানুল হুদার লেখা অনেক রিপোর্টের স্বাক্ষী আমি। অনেক সময় তিনি বলতেন আমি কম্পিউটারে কম্পোজ করতাম। অনেক রিপোর্ট নিয়ে তাঁর সাথে আমার দ্বিমত হতো, বিতর্ক হতো। দিন শেষে বুঝতাম তিনিই ঠিক ছিলেন, আমি ভুল।

সাংবাদিকতা নিছক চাকরি কিংবা পেশা নয় , একটা ব্রত-তা শিখিয়েছিলেন আহছানুল হুদা। তাঁর মতো একজন সাহসী সাংবাদিকের প্রয়োজন ছিল আনোয়ারায়। আসলে তাঁর মত মানুষের প্রয়োজন সমাজে সবসময় থাকে। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু সত্যপ্রকাশের আত্মবিশ্বাস আর আত্মবোধের শিক্ষা রেখে গেছেন। বয়সে প্রবীণ হয়েও তারুণ্যের আলোকে উদ্ভাসিত থাকতেন সবসময়। সেই আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন আরো বহুকাল কিংবদন্তির গল্প হয়ে।

(শুক্রবার ১৭ নভেম্বর সাংবাদিক আহছানুল হুদার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। আল্লাহ আহছান চাচাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন)

লেখক: আজাদ মঈনুদ্দীন
প্রধান নির্বাহী, সারাবেলা।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।