অধিকার বঞ্চিত শিশু—‘গাম বয়’, তৈরি করছে নাগরিক ঝুঁকি

শিশুর অধিকার নিশ্চিত মানেই—নিরাপদ, সুস্থ সমাজ

পরিবারের ছায়াহীন, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের একটা বড় অংশ ড্যান্ডি বা গাম আসক্ত। তাদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা এখনও পর্যন্ত বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেয়নি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ দিয়ে কাজ করলেও তা ওই শিশুদের সংখ্যার তুলনায় একেবারেই নগন্য। গাম আসক্ত শিশুদের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে তাদের কাজ নয়। চট্টগ্রাম নগরীর বেশ কয়েকজন বড় অপরাধীর বেড়ে ওঠা এবং তাদের শৈশব সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে—সংস্থাগুলোর দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগে এই ড্যান্ডি বা গাম আসক্তি দিয়ে তাদের অপরাধ জগতে প্রবেশ।। দৈনিক চট্টগ্রাম খবর বিভিন্ন সময় প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিমার্জিত প্রতিবেদন—অধিকার বঞ্চিত শিশু—‘গাম বয়’তৈরি করছে নাগরিক ঝুঁকি

ড্যান্ডি বা গাম কি? গাম সম্পর্কে মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. কফিল উদ্দিন চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে লিখেন—‘ড্যান্ডি হল এক প্রকার গ্লু গাম বা আঠা জাতীয় উদ্বায়ী পদার্থ বা সাধারণ তাপমাত্রায় সহজেই বাষ্পে বা ধূম্রে পরিণত হয়। সাধারণত চার প্রকার জৈব যৌগ যথা—টলুইন, বেনজিন, অ্যাসিটোন ও কার্বন ট্রাই ক্লোরাইড এই গাম জাতীয় পদার্থে বিদ্যমান থাকে। বিভিন্ন প্রকার রাবার ও চামড়া জাতীয় পদার্থ যেমন- জুতা, চাকার রাবার-টিউব প্রভৃতির মেরামতকল্পে সংযোজক কারক হিসেবে এর বহুল ব্যবহার বিদ্যমান। এই প্রকার উদ্বায়ী গাম জাতীয় পদার্থ বাষ্প বা ধূম্রাকারে গন্ধ শুকা বা শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্র হয়ে রক্তের মাধ্যমে মানব মস্কিষ্কে প্রবেশ করে, প্রথমে জাগায় আনন্দের শিহরশ আর অনিয়ন্ত্রিত উম্মাদনা, পরবর্তীতে তাহা দেহে আনে এক শিথীলতার ভাব। ফলে দীর্ঘমেয়াদে এই পদার্থের অপব্যবহারের ফলে এর প্রতি সৃষ্টি হয় এক চরম আসক্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যা ‘গ্লু স্নিফিং’বা বাংলায় ‘গ্লু গাম শুকা’নামে পরিচিত। আর সাধারণ মানুষ ও নেশাগ্রস্তদের নিকট ইহা ড্যান্ডি নামে পরিচিত।’

গাম বয় থেকে চোরের দলের দলপতি হানিফ
৯০ দশকের শুরুতে কোনো এক বিকেলে মায়ের সঙ্গে রাগ করে কুমিল্লা রেল স্টেশনে এসে ঘুরাঘুরি করেছিলো ৭ থেকে ৮ বছর বয়সের একটি শিশু। প্রথম যে ট্রেনটি ফ্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় সেটিতে উঠে সে। ট্রেন এসে রাতের বেলায় থামে চট্টগ্রাম স্টেশনে। ভিক্ষায় অনভ্যস্থ শিশুটি এর কাছে, ওর কাছে হাত পাতে। ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীরা গন্তব্যে ছুটে, শিশুটির দিকে তাকানোর কারো ফুসরৎ নেই।

ধীর কদমে ছেলেটি ফ্ল্যাটফর্মের বাইরে পা বাড়ায়। গিয়ে থামে স্টেশন রোড মসজিদের পাশের একটি সাইকেল দোকানের সামনে। মালিকের ঘরে ফেরার তাড়া। শিশুটি হাত পাতে, মালিকের মায়া হয়। তিনি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে তার ঘরে ফিরে যান। রাতের খাবার খেয়ে শিশুটি আবার ফ্ল্যাটফর্মে ফিরে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ক্লান্ত শরীর, শিশুটির শরীর তখন বিশ্রাম খুঁজছিলো। কিন্তু মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে বের হওয়া শিশুটির স্থান হলো চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের পুরাতন ভবনের বারান্দায়।

পরদিন আবার গেলো রাতের খাবার দেয়া সেই দোকানে। দোকানদার কাজের বিনিময়ে তাকে রেখে দিলেন। সাইকেল মেরামতের কাজ শুরু হলো কচি হাতে। সাইকেল মেরামত করতে গিয়ে সলিউশন গামের ঘ্রাণ তার প্রথম দিকে অস্বস্তি লাগলেও এক পর্যায়ে সেই গামের ঘ্রাণ ছাড়া শিশুটির আর চলে না। দরকার-বেদরকারে শিশুটি সলিউশন গামের ঘ্রাণ শুকে। এভাবে সে আসক্ত হয়ে যায় সলিউশন গামে।

সে দিনের কুমিল্লা রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে চট্টগ্রাম আসা শিশুটি আজকের দুই ডজন মামলার আসামি হানিফ ওরফে হাতকাটা হানিফ। সেই নব্বইয়ের দশকেই সাইকেল গ্যারেজে কাজ করে ঘুমানোর পর রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে আগুনে পুড়ে যায় তার হাত। চিকিৎসকরা তার হাত কেটে জীবন বাঁচান। সেই থেকে তার নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায় হাতকাটা শব্দটি, সে এখন হাতকাটা হানিফ।
গ্রামের সেই ছোট্ট হানিফ এখন পুলিশের খাতায় দেশের শীর্ষস্থানীয় চোর এবং চোরদের সর্দার। বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের গ্রিল কাটায় নানান প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে হানিফ। চট্টগ্রাম নগর ছাড়াও সারা দেশে তার হাতে গড়া কিশোর অপরাধী আছে শতাধিক। যারা চুরি, ছিনতাই করে হানিফের আশ্রয়ে থাকে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হানিফ জানায়, সলিউশন গামের ঘ্রাণে তার নেশা হতো। এরপর সাইকেল মেরামতের টাকায় তার খানা-পিনা চললেও নেশার টাকা জোগাড় করতে চুরির পথ বেছে নেয়। চুরির পর ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়। প্রথম দিকে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোড অর্থাৎ নিউ মার্কেট মোড় থেকে কদমতলী মোড় পর্যন্ত তার সীমানা ছিল। বর্তমানে দেশের রেল যোগাযোগ যেসব জেলায় আছে তার সব জেলার পাশাপাশি ভোলা, বরিশাল, খুলনা অঞ্চলেও তার হাতে প্রশিক্ষিত গ্রিল কাটা চোর আছে। আছে পাহাড়ি জেলাগুলোতেও।

মৃত্যুই ১৭ মামলা থেকে খালাস দিলো গাম আসক্ত মামুনকে
১৭ বছরের কিশোর মো. ইব্রাহিম। চট্টগ্রাম রেল স্টেশন পাড়ায় তাকে মামুন নামে সবাই চিনে। বয়সে কিশোর হলেও প্রাপ্ত বয়স্ক অনেক পেশাদার অপরাধীর কাছে সে ছিল অপরাধের ‘গুরু’। তার ক্ষিপ্রগতির ছিনতাই, চুরির কৌশল পুলিশ কর্মকর্তাদেরও অবাক করে দিতো। কাকতালীয় বিষয় হলো বয়সের সমানই তার মামলার সংখ্যা! অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলেই আইনের ফাঁক গলে ছাড়া পেয়ে যেতো। ড্যান্ডি বা গাম সেবন করে ছোট-খাটো অনেক অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিল মামুন। আদালতের আদেশে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠিয়েও লাভ হয়নি। বের হয়ে আবার জড়াতো অপরাধে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ—সিএমপির কোতোয়ালী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তী চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির প্রস্তুতি, অস্ত্র আইনে ইব্রাহিম প্রকাশ মামুনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা আছে। ট্রেনে কাটা পড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যায় মামুন। ১১ এপ্রিল সাগরিকা ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়েছিল মামুন। চিনকি আস্তানায় ট্রেন থেকে পড়ে পায়ে মারাত্মক আঘাত পায়। তাকে উদ্ধার করে পুলিশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়।
চিকিৎসকরা তার জীবন বাঁচাতে একটি পা কেটেও ফেলেন। রক্ত দরকার ছিল মামুনের, সেটিও দ্রুত ম্যানেজ হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি মামুনকে। মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগেও স্বজনদের সাথে স্বাভাবিক কথা বলেছিল মামুন। একটি পা হারিয়ে হয়তো বাঁচতে চেয়েছিল অপরাধ ছেড়ে। কিন্তু ১২ এপ্রিল মারা যায় মামুন। কোতোয়ালী থানাধীন পুরাতন স্টেশন এলাকায় জানাজা শেষে পাশের কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়।

মামুনের মৃত্যুতে আইন অনুযায়ী পুলিশের খাতায় তার নামে থাকা মামলাগুলো থেকে সে খালাস পাচ্ছে। কিন্তু মামুনের অপর দুই ভাই ইমরান, বশির, মা নাসিমা বেগম, বোন তানিয়া, মৌরমী, পিংকিও পুলিশের খাতায় অপরাধী। সবাই বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন।

মামুনের দুর্ঘটনা নিয়ে তার সহযোগীদের বরাতে কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক মোমিনুল হাসান বলেন, স্টেশনের রোড়ে চুরি-ছিনতাইয়ে সিদ্ধহস্ত মামুন হয়তো এবার ট্রেনে মোবাইল বা মালামাল ছিনতাই বা চুরি করতে গিয়েছিল। কারণ মামুনের বাড়ি ঢাকা, সাগরিকা ট্রেনটি গন্তব্য চাঁদপুর। তার সহযোগীরা বলছে মামুন ফেনীর উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠেছিল। গামে আসক্তি ছিল তার। কিন্তু ফেনী পৌঁছার আগেই ট্রেন থেকে পড়ে যায় বা কেউ ফেলে দেয়। এমনও হতে পারে আসক্ত থাকায় ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে গেছে। আহত অবস্থায় রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুন মারা যায়।

মামুনের পিতার নাম কলোন মিয়া। ঢাকার শ্যামপুর থানার পোস্তাগোলায় তাদের পৈত্রিক নিবাস। কলোন মিয়া বেশ কয়েক বছর আগে মারা যান। কিন্তু মামুনের মৃত্যুর নির্মমতা তার সহযোগীদের অপরাধ থেকে দূরে সরাবে কিনা সেটা সময় সাপেক্ষ বিষয় হলেও জানাজায় এসে মামুনের জন্য কাঁদতে দেখা যায় তার গাম সেবনের সহযোগী—সমবয়সীদের।

কোতোয়ালী থানা সূত্রে জানা গেছে, নিহত মামুনের বড় দুই ভাই ইমরান, বশির, মা নাসিমা বেগম, বোন তানিয়া, মৌরমী, পিংকির নামে মাদক বেচা-কেনা, চুরি ও ছিনতায়ের অভিযোগে থানায় দেড় ডজনের বেশি মামলা আছে। মামুনের পিতা কলোন মিয়া তার যৌবনে চট্টগ্রাম আসে। বরিশাল কলোনিতে বসবাস করতো। বরিশাল কলোনি থেকে মাদকের আখড়া উচ্ছেদের পর তারা স্টেশনের বস্তিতে এসে বসতি গড়ে। এখানে এসেও তারা মাদক ছাড়তে পারেননি।

পুলিশ জানায়—মাদকাসক্ত বলে নারীদের কেউ কোনো বাসা-বাড়িতে কাজ পায় না। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগের পর এসে আবার জড়ায় অপরাধে। পরিবারের পুরুষরা স্টেশনে চুরি-ছিনতাই করে। চট্টগ্রামে অপরাধ করে কুমিল্লা, চাঁদপুর অথবা ঢাকা, সিলেট চলে যায়। কয়েক দিন পর ফিরে আবার একই অপরাধ করে। এভাবে চলতে থাকে তাদের অপরাধ চক্র।

মামুনের মৃত্যুর সপ্তাহ না যেতেই তার ৮ সহযোগী পুলিশের জালে
২১ বছরের যুবক অপু—ছিনতাইকারীদের গ্যাং লিডার। তার টিমের সদস্যদের একজন ছিল ১১ এপ্রিল ট্রেনে কাটা পড়ে পা হারিয়ে ১২ এপ্রিল মারা যাওয়া মামুন। নগরীর পুরাতন স্টেশনে মামুনের জানাজায় অপুর দলের যারা জামিনে আছে সবাই উপস্থিত ছিল। জানাজার পর মামুনের দাফন শেষে সবাই জিআরপি ফাঁড়ির সামনের দোকানে আসে। কেউ কেউ চোখের পানি মুছতেছিল। এক পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠে।

কিন্তু সহযোগীর মৃত্যুও তাদের থামাতে পারেনি। আগের মতোই তারা সন্ধ্যা নামতেই ৩-৪ জনে উপগ্রুপে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায়। এরপর সুযোগ বুঝে হরেক রকম টিপ ছুরি ঠেকিয়ে পথচারীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেয় টাকা-স্বর্ণসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। ১৯ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে স্টেশন রোড এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে তার দুই ঘন্টা পর ১১টার দিকে কোতোয়ালীর পলোগ্রাউন্ড মাঠ থেকে ৮ জনকে টিপ ছুরিসহ আটক করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। সেখানে দলপতি অপু তার সহযোগী আব্দুল কুদ্দুস রুবেল (২৮), মো. আব্দুল রাজ্জাক (২৮), মো. সাদ্দাম হোসেন (৩০), নুর নেওয়াজ (১৯), মো. শুক্কুর (২২), মো. রায়হান ওরফে লালু (২০) ও মো. আলাউদ্দিনকে (২৭) নিয়ে আরও ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বলে জানায় পুলিশ।

পুলিশ আরও জানান, বাসে মোবাইল ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জানালা দিয়ে সেকেন্ডেই মোবাইল নিয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে যায় গ্রুপের সদস্যরা। ১টি গ্রুপ টিপ ছুরির ভয় দেখিয়ে সুযোগ বুঝে মোটরসাইকেল যাত্রী, সিএনজি যাত্রীদের পথরোধ করে এবং পথচারীদের নগদ টাকা, মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়।

ছিনতাইয়ের টাকার একটা অংশ অপু লগ্নি করে শিশুদের ড্যান্ডি সেবনে
এই দলের দলপতি অপু তার চেয়ে বয়সের দ্বিগুণ ছিনতাইকারীদের দলে লালন-পালন করে। তার বিরুদ্ধে সবচে বড় অভিযোগ—স্টেশন এলাকার ছোট ছোট শিশুদের গাম আসক্ত করতে সহযোগিতা করার। নিউ মার্কেট গোল চত্ত্বরে ৮-১০ জনের ছোট ছোট শিশু পলিথিনে গাম নিয়ে গামের ঘ্রাণ নিচ্ছিলো। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—তাদের গামের টাকা অপু এবং তার সহযোগীরা সরবরাহ করে। অপু কেন টাকা দেয়? জানতে চাইলে শিশুরা জানায়—তারা অপু এবং তার দলের অপর সদস্যদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। কী তথ্য দাও তোমরা? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়—কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে তারা চিনে। সেই কর্মকর্তারা যদি নিউ মার্কেট এলাকায় আসে মুহূর্তেই খবর পাঠিয়ে দেয় অপু এবং তার দলের কাছে।

অপুকে কীভাবে খবর দাও? তাদের উত্তর—‘অপু ভাইয়া সবসময় আমাদের সামনে আসেন না। কেউ একজন আমাদের ওপর নজর রাখেন। আমরা ইশারা করলে তিনি চিনেন। তিনিই অপু ভাইয়াকে খবর দেন যে পুলিশ আসছে। যিনি নজর রাখেন তিনি আপনাকেও দেখছেন। আপনি কী কথা বলছেন তা আমাদেরকে আবার জিজ্ঞেস করবে, চলে যান।’

অপু এবং তার দল সম্পর্কে কোতোয়ালী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেজাম উদ্দিন বলেন, অপু নিজেও আরেকজনের সৃষ্টি। শুধু অপু নয় বরিশাল কলোনির সেই ফারুক, ইউসুফ, পিচ্ছি আলো থেকে শুরু করে পুলিশের খাতায় শীর্ষ অপরাধীদের বেশিরভাগ উঠে এসেছে রেল স্টেশন থেকে। কেউ কুলি ছিল, কেউ ভিক্ষুক। এরা সবাই গাম আসক্ত হয়েছিল। গামের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে প্রথমে চুরিতে হাতেখড়ি, তারপর ছিনতাই। বড়সড় চুরিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। বাদ যাচ্ছে না অফিস, বাসা-বাড়িও। ছোট ছোট শিশুরা বড়দের তথ্য দেয়। সেই অনুযায়ী তারা টার্গেট ঠিক করে ছিনতাই করে। মোবাইল, মানিব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি তারা এক সময় এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনকারীদের ফলো করতো। এখন তারা ব্যাংকে বড় লেনদেনকারীদের টার্গেট করে। ছিনতাই হওয়া ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে আমরা সিসি ক্যামরায় অপুর গ্রুপের সদস্যদের উপস্থিতি পেয়েছি। ৮ থেকে ১২ বছরের গাম আসক্ত শিশুরাও এখন তথ্য দিয়ে ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন অপরাধীদের সহায়তা করছে।

স্টেশনের সেই মায়াবী শিশুটি এখন পুলিশের খাতায় ‘দক্ষ-অভিজাত চোর’
‘শ’ দিয়ে নাম শুরু। দেখতে বেশ আদুরে শিশু। চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে আসা যাত্রীরা তাকে দেখে আদর মাখা হাত বুলিয়ে দিতেন তার মাথায়। এগিয়ে এসে বোঝা নিতে চাইলে শিশুর মাথায় কেউ বোঝা না দিয়ে ৫/১০ টাকা হাতে দিয়ে দিতেন। সেই মায়াবি চেহারার শিশুটি এখন কিশোর। অন্য দুই চার দশটা শিশু-কিশোরের মতো তারও স্কুলের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বিদ্যা অর্জনের জন্য ছুটার কথা। কিন্তু নিয়তি তাকে টেনে এনেছে এক অন্ধকার জগতে। চট্টগ্রাম শহরে কোনো শিশুর শখের বাইসাইকেল চুরি হলেই পুলিশের চোখে ভেসে ওঠে ‘শ’ দিয়ে শুরু হওয়া শিশুটির নাম। বছরে অর্ধশতের বেশি বাইসাইকেল চুরি হয় তার হাতে। মাত্র তিন সেকেন্ডে সে সাইকেলের যে কোনো তালা খুলতে পারে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর বয়স বিবেচনায় জামিন হয়। জামিনে এসে আবারও করে চুরি।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিশুটি জানায়—সাইকেল যে মানেরই হোক তারা বিক্রি করে এক থেকে তিন হাজার টাকায়। সেই টাকা গ্রুপের সবাই মিলে ভাগ কর নেয়। সাইকেল বিক্রির টাকায় ২/১ বেলা ভালো খাবার খেলেও বাকি টাকা নেশা করে উড়ায়! কী ধরণের নেশা করে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক মোমিনুল হাসান জানান—বেশিরভাগ সময় সে এবং তার দলের কিশোররা গাম টানে। মাঝে মধ্যে গাঁজা সেবন করে বলে স্বীকার করেছে। শিশুদের দিয়ে সাইকেল চুরি করানোর একটা চক্র আছে। তারা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাদের বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা কী জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রের অনেককে আমরা বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছি। তারা জামিনে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ভাসমান হওয়ায় তাদেরও গ্রেপ্তার সব সময় সম্ভব হয় না।

বিভিন্ন সময় সাইকেল চুরি করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে কিশোর ‘শ’। ঘুরেফিরে তার নামই কেন আসে জানতে চাইলে মমিন হাসান বলেন, শিশুটির চেহারায় আভিজাত্য আছে। সাধারণ পোশাকেও শিশুটিকে ধনীর দুলাল ভাবে যে কেউ। সাইকেলের তালা ভাঙ্গার পর সে যখন সাইকেলে চড়ে বসে তখন সবাই ভাবে সেই সাইকেলের মালিক। কারো সন্দেহ হয় না। নগরীর একাধিক সুরক্ষিত অভিজাত এলাকার সিসি ক্যামরায় তার চোরাই সাইকেল চালিয়ে চলে যাওয়ার ফুটেজ আমরা পেয়েছি। সিকিউরিটেদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে—কোনো সাহেবের ছেলে হবে ভেবে আমরা তাকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

জামিনে এসে অন্যান্যদের সঙ্গে চট্টগ্রাম ষোলশহর রেল স্টেশনে আড্ডা দিচ্ছিলো সেই কিশোর। হাতে তার গামের পোটলা। কথা বলার এক পর্যায়ে কিশোর ‘শ’ জানায়—‘মনে অনেক দুঃখ ভাইয়া। আমরার মনেও তো চায় বাপ-মা, ভাই-বোন নিয়া থাকতে। কিন্তু বাপ যে আমাগোরে ফেলাইয়্যা গেছে, মায়ে আর কী করবো? অভ্যাস অইয়্যা গেছে। ডান্ডি (ড্যান্ডি), কলকিই এখন আমাগো জীবনের অংশ। রক্তে চুরিদারি মিশ্যা গেছে।’

এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে চায় না সমাজসেবা কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেউ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপরিচালক মো. ফরিদুল আলম বলেন—আমরা সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুদের দায়িত্ব নিয়ে থাকি। তাদেরকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করি। গাম আসক্তদের দায়িত্ব মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দাবি—গাম মাদক হিসেবে এখনও শিডিউলভুক্ত নয়। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মেট্রোর উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুকুল জ্যাতি চাকমা বলেন—‘গাম আমাদের সিডিউলভুক্ত না হওয়ায় আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না।’ গাম তৈরির উপাদান টলুইন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শিডিউলভুক্ত উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘টলুইন গামে ব্যবহার হয়। টলুইন সরাসরি মাদক হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। এক্ষেত্রে আমরা সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাতে পারি যাতে তারা গাম আসক্ত না হয়।’

এভাবে এই চক্র চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এর শেষ কোথায়? হ্যা, শেষ আছে। দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে, পদক্ষেপ নেয়। সংস্থার প্রধান বদলি হলে সেই পদক্ষেপ আর বাস্তবায়ন হয় না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে, জেলা প্রশাসনও করার আশ্বাস দিলো।

চক্র ভাঙ্গতে পুলিশের পদক্ষেপ, দেখেনি আলোর মুখ
বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি (ট্রেনিং এন্ড রিসার্চ) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে এসে বিষয়টিতে নজর দেন। একটি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন—চট্টগ্রাম রেল স্টেশন, নিউ মার্কেট, ষোলশহর স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা অধিকার বঞ্চিত শিশুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসিত করার। কিন্তু তাঁর বদলির পর সেই চুক্তি পরবর্তী কমিশনার বা পুলিশের পক্ষ থেকে আর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সালেহ মোহাম্মদ তানভীর চট্টগ্রাম খবরকে বলেন—কোনো শিশুই অপরাধী হিসেবে জন্মায় না। তাদের অধিকারগুলো আমরা নিশ্চিত করতে পারলে তারা সমাজের জন্য ঝুঁকি নয় সম্পদ হিসেবে কাজে লাগবে। সেই চিন্তা থেকে আমরা একটা পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসি। কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করতে পারলে তারা সমাজকে কিছু দিতে পারতো। আমি আশা করবো সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবেন।

পথ দেখাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন—মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আলোচিত এক শহীদের নামে সংগঠনটি গঠিত। গাম আসক্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। সংগঠনের কর্ণধার তাঁর নিজের নাম, সংগঠনের নাম প্রকাশ না করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। সংগঠনটি শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানান বাধা পেয়েছে। সব বাধা উপেক্ষা করে গত ২ বছরে তারা ২২ জন শিশুকে গাম আসক্তি থেকে ফিরেয়ে এনেছেন স্বাভাবিক জীবনে। সেই ২২ জনের সবাই পড়াশোনা করছে, তাদের ৫ জন শিক্ষার্থী কলেজ লেভেলে পড়ছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলায় তাদের থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী নিজেদের মনের মতো ১২টি প্রোজেক্ট প্রদর্শন করে সবার নজর কেড়েছে।

আশার বাণী শোনালেন জেলা প্রশাসক
চট্টগ্রাম নগরীর শীর্ষ অপরাধীদের বড় একটা অংশের বেড়ে ওঠা অধিকার বঞ্চিত শিশু হিসেবে। তাদের অধিকার নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে কিনা—জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এতদিন এভাবে ভাবতে না পারাটাও দুঃখজনক। আমাদের দৃষ্টিতে যেহেতু এনেছেন আমরা অবশ্যই পদক্ষেপ নেবো। কারণ, এই শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে আমার-আপনার সাবার জীবন নিরাপদ হবে। তাদের মেধা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগবে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।