ইউটিউব দেখে মিশ্র ফল চাষে সফল প্রবাস ফেরত সোহেল

প্রবাসে ভাগ্য পরিবর্তন না হলেও দেশে ফিরে সাম্মামসহ মিশ্র ফল চাষে ভাগ্য ফিরেছে সোহেলের। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সুদুর ওমানে পাড়ি জমান ফেনী জেলার লস্করহাট এলাকার মো. সোহেল। দীর্ঘ নয় বছর ওমানে অবস্থান করার পর দেশে ফেরত এসে নিজে কিছু করার আশা নিয়ে শুরু করেন মিশ্র ফলের চাষ। মনোযোগ দেন কৃষিতে। কৃষি জমি হিসেবে বেছে নেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাগান বাজার ইউনিয়নের লালমাই এবং দাঁতমারা ইউনিয়নের বালুটিলা এলাকাকে।
প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে লালমাই এলাকায় পেপেসহ মিশ্র ফলের চাষ করেন তিনি। প্রাথমিক সফলতা পেলেও যোগাযোগসহ নানা পারিপার্শ্বিক কারনে সেখান থেকে চলে আসেন দাঁতমারা ইউনিয়নের বালুটিলা এলাকায়। বালুটিলার কালাকুম নামক স্থানে ২০০ শতক জমিতে গড়ে তুলেছেন সাম্মাম,বারোমাসি তরমুজ, মালচিং পদ্ধতিতে হাইব্রিড মরিচ, পেঁপেসহ মিশ্র ফলের বিশাল ফলজ বাগান।
তাঁর এই মিশ্র ফলের বাগানে রয়েছে প্রায় দুই হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পেপে গাছ, মালচিং পদ্ধতির হাইব্রিড মরিচ, অন্তত দুই শতাধিক বারোমাসি তরমুজ, প্রায় চার শতাধিক সাম্মাম গাছ।

বালুটিলা জিলতলী সড়ক লাগোয়া তাঁর এই বহুজাতিক মিশ্র ফলের বাগানে প্রবেশ করলে মন জুড়িয়ে যাবে যে কারো। বারোমাসি তরমুজ ও মরু অঞ্চলের ফল সাম্মাম চাষ করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তিনি। নতুন জাতের বিদেশি এ ফল দেখতে ও এটির সম্পর্কে জানতে প্রতিদিনই প্রচুর দর্শনার্থী আসছেন তাঁর মিশ্র এ ফল বাগানে। পাশাপাশি তাঁর এ উদ্যোগে অনেকেই মরু দেশের জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু ফল সাম্মাম চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ভিন্ন জেলার অধিবাসি হলেও তাঁর ফলজ বাগানের কারনে এ এলাকার মানুষের সাথে তাঁর গড়ে উঠেছে সখ্যতা।

সম্প্রতি সোহেলের মিশ্র বাগানে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি লাগানো হয়েছে তাইওয়ানের উচ্চ ফলনশীন রেড লেডি, রেডজয় ও টপলেডি জাতের পেপে গাছ। এসব গাছে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় পেপে ঝুলছে। আবার কোনো কোনো গাছে এসেছে ফুল। এছাড়া নিজেই গড়ে তুলেছেন আধুনিক পদ্ধতির চারার নার্সারি।

বাগানে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মো. সোহেলের সঙ্গে। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ৯ বছর ওমানে প্রবাস জীবন কাটিয়েও পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারেননি তিনি। বর্তমানে তাঁর মিশ্র ফলের বাগানে যে শ্রম দিচ্ছেন তিনি তার চারগুন শ্রম দিয়েও মাস শেষে ঠিকভাবে বেতনও পাননি। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে দেশে এসে মনোযোগ দিলেন কৃষিতে।

ইউটিউব দেখে মিশ্র ফল চাষে সফল প্রবাস ফেরত সোহেল 1

ইউটিউবে এসব মিশ্র ফলের বাগান চাষের প্রক্রিয়া দেখেই তিনি এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম ধাপে তেমন সফল না হলেও এখন তিনি তাঁর বাগান নিয়ে বেশ উৎফুল্ল বলে জানান। বাগানের ফলন দেখে খুশি তাঁর মা এবং স্ত্রীও। দুইশ শতক জমিতে পেপে, মরিচ,তরমুজ আর সাম্মামে মোট ৭ লাখ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন তিনি। তার মধ্যে পেঁপে বিক্রি করে ইতোমধ্যে আড়াই লাখ টাকা পেয়েছেন। সিজন শেষে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার ফল বিক্রির আশা প্রকাশ করছেন তিনি। তার মধ্যে শুধু পেপে বিক্রি থেকে ৯ লাখ টাকা আয়ের প্রত্যাশা তাঁর। বাকীটা তরমুজ, সাম্মাম এবং মরিচ বিক্রি করে আসবে।

এসব ফলজ বাগান করতে গিয়ে বিগত চার বছরে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে জানিয়ে সোহেল বলেন, আগের চেয়ে অনেক ভাল আছেন তিনি। আগে পরের অধীনে ছিলেন ঠিকমত বেতনও পেতেন না। এখন তিনি নিজেই তাঁর বাগানে ১০/১২ জন শ্রমিক খাটান।

আমাদের দেশের মাটি অনেক উর্বর জানিয়ে সোহেল বলেন, পরিকল্পিতভাবে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরন করে বেলে মাটিতে সাম্মাম চাষ করলে ফলন ভাল হবে। এ ছাড়া দোঁয়াশ মাটিতে বারোমাসি তরমুজের ফলন হবে ভাল। বিভিন্ন সময় কৃষি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ গুলোতে অংশ নেয়ার পাশাপাশি অনলাইন থেকে নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তা থেকে নিজেই প্রয়োগ করেন তিনি।
তবে এ বিশাল ফলজ বাগান করতে গিয়ে কোন ধরনের সরকারী সহায়তা পায়নি বলেও জানান তিনি। দুইশ শতক মিশ্র ফলের বিশাল বাগানের বিনিয়োগ করা পুরো অর্থই নিজের এবং তাঁর ভাইয়ের বলে জানান তিনি। আগামী বছর পাশে আরো জমি নিয়ে নেপালি আখেঁর চাষসহ সাম্মাম এবং বারোমাসি তরমুজের চাষের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করবেন বলে জানান তিনি।

এছাড়া মালচিং পদ্ধতিতে হাইব্রিড মরিচ চাষেও এসেছে ব্যাপক সফলতা। প্রতিটি মরিচ গাছে ফলনও হয়েছে। মরচি গাছ থেকে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মরিচ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন তিনি।
সোহেল বলেন, প্রবাসে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত না হয়ে আমাদের দেশের বেকার তরুণ এবং যুবকরা যদি ছোট পরিসরে নিজেরা এধরনের ফলজ বাগান করে তাহলে নিজের আয় হওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হবে আত্মকর্মসংস্থানের।

এ বিষয়ে দাঁতমারা ইউনিয়নে দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন,
‘আমি তাঁর বাগানটি বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। কৃষি অফিস থেকে তাকে বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেয়ার আশ্বাস দেন এ কর্মকর্তা।’

ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, উত্তর ফটিকছড়ির দাঁতমারা ও বাগানবাজার ইউনিয়নসহ পুরো ফটিকছড়ি কৃষি বিপ্লবের উর্বর এলাকা। ইতোমধ্যে এসব এলাকায় অনেক তরুণ উদ্যোক্তা মাল্টা, ড্রাগন, আম, লেবু, পেপে, সাম্মামসহ মিশ্র বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বাগান করে বাজিমাত করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘সোহেলের মতো যেসব শিক্ষিত তরুণরা কৃষি বিপ্লবে নিজ উদ্যোগে কিছু করার জন্য এগিয়ে আসছেন তাঁদেরকে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সব ধরণের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রবাস ফেরত সোহেলকে সবরকম সহযোগিতার জন্য স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে বলে দেয়া হয়েছে।’

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।