জাতির পিতাকে হত্যার সাথে জাতির বিবেকের আত্মহত্যা

গণমাধ্যম হচ্ছে জাতির বিবেক, এমন কথা সর্বজনস্বীকৃত। সাংবাদিকদের কলমে জাতির বিবেক জেগে উঠতে বাধ্য। প্রতিটি গণমাধ্যম তাই জাতির বিবেক হিসেবে কতখানি কাজ করতে ইচ্ছুক, তা জানান দিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আইডেন্টিটি প্রচার ও প্রকাশ করে। যেমন, কেউ সত্য সংবাদ প্রকাশে নির্ভীক, কেউবা সত্য সংবাদ প্রকাশে আপোষহীন, ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার শোকে মুহ্যমান আমরা। তবুও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখেই জাতির বিবেক কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে চাই।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ এ। যদিও এর আগে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তাঁর কর্মপরিকল্পনা-দর্শন ও স্বপ্নের স্পষ্ট রূপরেখা দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণের খুঁটিনাটি সংবাদ।

পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু হয়। সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে দেশকে। জাতির বিবেক গণমাধ্যমও মুখরিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণের সংবাদ প্রকাশে। কিন্তু খুব অল্প দিনের মধ্যেই কীভাবে এবং কেনো জাতির বিবেক সঠিক সত্য প্রকাশের চেয়ে তৈরিকৃত সঠিক সত্য প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে গেল, তা নিয়ে গবেষণার দরকার আছে। এর প্রমাণ পেলে ১৯৭২ এ স্বাধীন বাংলাদেশে পালিত হওয়া হওয়া প্রথম বিজয় দিবসে জাতির পিতার দেওয়া ভাষণে উঠে আসা ক্ষোভ থেকে। ১ ঘন্টা ৪ মিনিটের সেই ভাষণে তিনি প্রকাশ করলেন এই এক বছরে দেশ গড়ার সংগ্রামে মুখোমুখি হওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার। মাত্র এক বছরেই যেন তাঁর বোধোদয় ঘটেছিল! যে বাঙালিকে তিনি তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি বলে ভাবতেন, সেই বাঙালির সুবিধাবাদী পক্ষ দেশের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে, এ যেন তাঁর কাছে ছিল বড় বেদনার। গণমাধ্যম কি সেই স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেছিল? একটি অংশ মোটেও তা করেনি। আর তাই কলমসৈনিকদের নির্দিষ্ট অংশের উদ্দেশ্যে সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অনেকে যা ইচ্ছা আসে অমনি ল্যাইখা ফেলান।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ‘যা ইচ্ছা আসে অমনি ল্যাইখা ফেলান’ নয়, তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রার শুরু থেকেই গণমাধ্যম এই কাজটি করেছে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব তৈরি করতে জাতির বিবেক ভ্রুক্ষেপ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমনটি ঘটেছিল। শহীদ সাংবাদিকদের ধরিয়ে দিতে নামের তালিকা যারা করেছিলেন, তারাও সাংবাদিকই ছিলেন। আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন একজন। ক্যান্টনমেন্টে খাবার সরবরাহ করার অভিযোগও আছে কারোর বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর উক্তি ধার করে তাই বলতে হয়, ‘সব সাংবাদিক ফেরেশতা নন।’

ঠিক আছে। সাংবাদিকদের অনেকেই ফেরেশতা ছিলেন না। তারা হত্যাকারীদের সমর্থনে সম্পাদকীয় ছাপালেন, ঠান্ডা মাথায় চেপে গেলেন দেশের রাষ্ট্রপতিকে নৃশংসভাবে হত্যার কথা, দশ বছরের শিশু-অন্তঃসত্ত্বা ও নবপরিণীতা নারীকে হত্যার সঠিক তথ্য কিছুতেই প্রকাশ করলেন না। এখন আসলে বিশ্বাস হতে চায় না এ সত্য। বিশ্বাস করার জন্য সেই সময়ের পত্রিকা পড়ার আহবান করছি।

’৭৫ এর সময়ে তো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। পত্রিকা আর বেতারই ভরসা। হত্যাকান্ড ভোরের দিকে ঘটায় ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের কোনও পত্রিকায় তা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়নি। সেদিন পত্রিকায় লীড নিউজ ছিল জাতির পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ দূত সোয়ং চুং বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ইত্যাদি। সেই সকালের পত্রিকার পাঠকসহ আপামর জনতা আচমকা বাংলাদেশ বেতারকে পাকিস্তান আমলের মতো রেডিও বাংলাদেশ হতে শুনলেন, শুনলেন রূক্ষ্ম ঘোষণা দেশে ক্যু হয়েছে। ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা সরাসরি বলেছিল কি না খুনির দল, তা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। একবার নাকি বলা হয়েছিল। আর বারবার বলা হয়েছিল নয়া সরকারের ক্ষমতাদখলের কথা।

স্বাভাবিকভাবেই, পরদিনের পত্রিকায় জাতির বিবেক সব সত্য দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ করবে, সেটাই তো কাম্য ছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু হতাকান্ড বা নৃশংসতার কোনো বর্ণনা সেদিন পত্রিকাগুলোর কোথাও ছিল না। ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ সশস্ত্র বাহিনী সাবেক রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বাসভবনে নিহত করে (সপরিবারে নিহত করে, তা কিন্তু বলা হয়নি একবারও) নয়া রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় বসানো, সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারির খবরের পাশাপাশি নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা ও পাকিস্তানের স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়গুলো ছিল অমৃত বচনে ভরপুর। উদাহরণ হিসেবে দেখি- দৈনিক বাংলা শিরোনাম দিয়েছিল ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’, বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল Historical Necessity, দৈনিক ইত্তেফাকের ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’!
জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন, দশ বছরের শিশুহত্যা কীভাবে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হতে পারে? অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হত্যাকান্ডকে কি সত্যিই Historical Necessity বলা যায়? রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিবর্তন আনতে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক নবযাত্রার সূচনা করেছিল বলে সত্যিই কি কোনো বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করতে পারে?

১৭ আগস্ট তারিখে দৈনিক বাংলার প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়-‘সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ শনিবার বিমানযোগে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে তাদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।’ সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তারা কি বেঁচে আছেন নাকি হত্যার শিকার হয়েছেন, তাদের লাশ কী করা হয়েছিল, সেসব কোনো তথ্য ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আসার আগ পর্যন্ত গণমাধ্যমের কোথাও কোনো সংবাদ বা তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

একই তারিখে আরেকটি সংবাদ গুরুত্বপূর্ণ। ১৪ আগস্ট বা এর আগে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সকল প্রামাণ্য ছায়াছবি ও সংবাদচিত্র প্রত্যাহার ও প্রিন্টগুলো অবিলম্বে মন্ত্রণালয়ে জমাদানের জন্য সরকারি নির্দেশ জারি করা হয়েছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করতে হবে, যাতে তাঁর বিরুদ্ধে করা অপপ্রচার ও গুজব এক সময় সত্য বলে প্রমাণিত হয়। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে তথ্য-প্রমাণ নষ্টের তান্ডব চালানো হয়েছিল। সেই সময়ের কয়েকজন দেশপ্রেমিক সাহসী কর্মকর্তার জীবনবাজি রেখে লুকিয়ে সংরক্ষণ করা তথ্য-প্রমাণ আজ দেখতে পাই। এর বাইরেও আরও অনেক কিছু হয়তো ছিল, যার জন্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু করার নেই।

এরপর সচেতনভাবে রেডিও বাংলাদেশের মতো বদলে ফেলা হয় গোটা বাংলাদেশের ইতিহাস। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কোনও ছবি ছিল না, ছিল না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কোনও চিহ্নও। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর তারিখে প্রাসঙ্গিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে পত্রিকাগুলো নির্লজ্জের মতো বাদ দিতো বঙ্গবন্ধুর নাম, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বদলে কেবল হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়েছিল বলে লেখা হতো। গোয়েবলস নীতিতে ক্রমাগত অপপ্রচার ও গুজব রটানো হয় এই বলে যে, বঙ্গবন্ধু নাকি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেছিলেন! মাত্র ৪টি পত্রিকা রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়ার এই অপপ্রচারের বিপরীতে সত্য জানতে ১৯৭৫ সালের ১৭ জুন জারিকৃত সংবাদপত্র (ডিক্লারেশন বাতিলকরণ) অর্ডিন্যান্স বিষয়ে সেই সময়ের পত্রিকার সংবাদ দেখলে জানা যায়, অর্ডিন্যান্সে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, ১২৪টি দৈনিক, সাপ্তাহিক, দ্বিপাক্ষিক, মাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক পত্র-পত্রিকাকে বাতিল করা হয়নি। কোথায় ৪ আর কোথায় ১২৪!

এতে আসলে কী ঘটল? জাতির বিবেক সব সময় সত্য প্রকাশে অবিচল নয়, সেই তথ্যটি বাংলাদেশের মাটিতে প্রমাণিত হয়ে গেল। এতে কেউ কেউ লাভবান হয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে, তবে পেশাগত দিক দিয়ে ভাবলে দুঃখের সাথে বলতে হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে স্বার্থান্বেষী পক্ষের কাছে দাসখত দিয়ে জাতির বিবেক আসলে আত্মহত্যা করেছিল। সত্যিকারভাবে বেঁচে উঠতে উচিত হবে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা আর আত্মশুদ্ধি ছাড়া এই যাত্রায় উদ্ধারের আর কোনো উপায় আছে কি?—পিআইডি ফিচার

লেখক—কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।