মরে যাবো, তবুও চিকিৎসা করাবো না

লজ্জা ভেঙ্গে চিকিৎসা করুন- ডাঃ তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী

আমি মরে যাবো, তবুও আমার লজ্জাস্থান কোন পুরুষ ডাক্তারকে দেখাবো না, চিকিৎসা করাবো না। এ কথাগুলো ৮ বছর আগে বলেছিলেন সুমি (ছদ্মনাম)। সুমি আক্তার তার রোগের জন্য শরণাপন্ন হয়েছিলেন দেশের প্রথম নারী ইউরোলজিস্ট ডা. তাজকেরা সুলতানা চৌধুরীর।

ঢাকায় জিগাতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন সুমি। প্রস্রাবের সময় জ্বালা-পোড়া, প্রস্রাবের রাস্তায় ক্ষতসৃষ্টিসহ অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাব ঝরায় সুমির রাত-দিন কাটত বিষণ্ণতায়। লজ্জায় পরিবারের কারো সাথেও বিষয়টি আলাপ করতে পারেনি সুমি। শেষে এক বান্ধবী বিষয়টি জানার পর সন্ধান দেয় ডা. তাজকেরা সুলতানার। বর্তমানে তিনি সদা উৎফুল্ল একজন নিবেদিত ভলান্টিয়ার। ডা. তাজকেরার চেম্বারে আসা প্রস্রাব ঝরা সমস্যায় ভোগা রোগীদের মানসিক শক্তি যোগাচ্ছেন সুমি।

মরে যাবো, তবুও চিকিৎসা করাবো না 1

চট্টগ্রাম খবরের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে আলাপ হয় ডা. তাজকেরা সুলতানা চৌধুরীর। আলোচনায় উঠে আসে নানা সমস্যার বিষয় ও সমাধান।

আলাপচারিতায় জানা যায়, ‘প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়া এবং প্রস্রাব ঝরা জাতীয় রোগকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ফাংশনাল ইউরোলজির বিষয়বস্তু হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে এই ধরনের রোগী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে। এ ধরনের সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দিলে অনেকেই লজ্জায় চেপে যেতে চান। অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাব ঝরার কারণে ঘরের বাইরে যায় না এ সকল রোগী। এমনকি পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান যোগ দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে আপন গৃহে রোগী নিগৃহীত হওয়ার গল্পও আছে। এক পর্যায়ে প্রস্রাব ঝরা রোগের সাথে মানসিক সমস্যা যুক্ত হয়ে জটিল আকার ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।

ডাক্তার তাজকেরা আরও বলেন, প্রস্রাব ঝরা একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। কিন্তু এই রোগের চিকিৎসায় প্রধান বাধা হচ্ছে– লজ্জা। আমার নিজের মায়েরও প্রস্রাব ঝরা রোগের সমস্যা দেখা দিলে তিনি তা লুকানোর চেষ্টা করেছেন। আমার সাথে সহজেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে চাননি। আমি রীতিমত জোর করে উনাকে চিকিৎসা দিয়েছি। তাই এই লজ্জাবোধের বিষয়টি অতিক্রমের জন্য আমাদের-কে একসাথে কাজ করতে হবে।

মরে যাবো, তবুও চিকিৎসা করাবো না 2

কেন ইউরোলজিস্ট হতে চেয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. তাজকেরা বলেন, মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই ইউরোলজিতে আমি একজন বিশেষজ্ঞ হতে চেয়েছি। এই সেক্টরে আসার বিষয়ে অনেকের অনাগ্রহ আছে। যার কারণে এই সেক্টরে আমিসহ মাত্র অল্প কিছু নারী ইউরোলজিস্ট আছে। আরও বেশ কয়েকজন আগামীতে ইউরোলজিস্ট হচ্ছেন। তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

আমিই প্রথম বলয় থেকে বের হয়ে মানুষকে সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়েছি। বলতে পারেন প্রস্রাব ঝরা রোগ থেকে দেশের মানুষকে প্রতিকার দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আমি রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।

আমি কিছু পরিকল্পনা নিয়ে ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের দিকে এগুচ্ছি। যেমন- আমার প্রতিটি রোগী সুস্থ হয়ে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তাঁরা এখন এডভোকেসি করছে। আমার কাউন্সেলিং টিমের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করছে। আমিও সারাদেশে তরুণ ডাক্তারদের নিয়ে টিম গঠন করেছি । তাদেরকে অনলাইন-অফলাইনে ব্রিফিং করছি। প্রস্রাব ঝরা রোগের উপসর্গ, মানসিক এবং অন্যান্য বিষয়গুলো শনাক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছি। যে কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারেন, প্রচারে সহায়তা করতে পারেন।

সাধারণ মানুষ কিভাবে এই প্রচারণায় অংশ নিতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. তাজকেরা বললেন, এই যে প্রস্রাব ঝরা রোগ নিয়ে চট্টগ্রাম খবর এর মাধ্যমে যে সকল মানুষ জানবে তাঁরা সকলেই চাইলে ফেইসবুকে কিংবা  ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি শেয়ার করতে পারেন। ডিজিটাল যুগে আমাদের একটি তথ্য শেয়ার করে যদি একজন রোগীও উপকৃত হয় তা হবে আমাদের মানবিক দৃষ্টান্ত। এখানে কোন পন্যের বিজ্ঞাপন নয় বরং একটি রোগের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে।

এভাবেই আমাদের ম্যানুয়্যাল, ডিজিটাল মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার করতে হবে। আর এভাবেই আমরা লজ্জাকে জয় করতে পারি, মানুষের উপকারে নিজে অংশীদার হতে পারি।

সাধারণ মানুষের কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা থাকলে ডা. তাজকেরা তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলেও চট্টগ্রাম খবর-কে জানান।

তিনি বলেন- চট্টগ্রাম খবর আমার এই ক্যাম্পেইনের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করবে। তাই রোগীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন আসলে নির্দেশিত ই-মেইলে পাঠালে তার উত্তর আমরা দিব।

দেশের প্রথম নারী ইউরোলজিস্ট তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী এবং তার হাতে গড়া নারী চিকিৎসকরাই এখন ইউরোলজির সকল চিকিৎসা দিচ্ছেন রোগীদের। তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী ২০১৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী ইউরোলজিস্ট হিসেবে যাত্রা করেন। তিনি কুমিল্লা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি এফসিপিএস (সার্জারি), এমএস (ইউরোলজি) তে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে বাওয়া স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

গত ৭ বছর ধরে তিনি নারীদের ইউরোলজির যাবতীয় চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিডনি, মূত্র থলিতে পাথর ও টিউমার, প্রসাবের সাথে রক্ত যাওয়া, যে কোনো বয়সীদের প্রস্রাব ঝরা, প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া, বাচ্চাদের বিছানায় প্রস্রাব করা, মলদ্বারে ব্যথা, ফিস্টুলা ও পাইলস, ব্রেস্ট ক্যানসার, ব্রেস্ট পেইন, ব্রেস্ট টিউমার এর চিকিৎসা প্রদান করেন তিনি।

মরে যাবো, তবুও চিকিৎসা করাবো না 3

ডা. তাজকেরা সুলতানার চিকিৎসা সেবায় রোগীরা বেশ সন্তুষ্ট। তার হাতে চিকিৎসা সেবা নেওয়া আরেক রোগী দিলরুবা খানম চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, ‘আমার দীর্ঘদিন ধরে প্রস্রাব ঝরতো। লজ্জায় আমি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম না । আমি গৃহবন্দী হয়ে পড়ছিলাম। স্রষ্টাকে দিন রাত কেঁদে কেঁদে বলতাম, স্রষ্টা আমাকে তুমি রোগ হতে মুক্তি দাও। স্রষ্টা আমার ডাক শুনেছেন, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসক তাজকেরা সুলতানা সম্পর্কে জানতে পারি। পর দিনই আমি চলে যাই তাজকেরা সুলতানার কাছে। তার পরামর্শ মতো ওষুধ খেয়ে ও চলাফেরা করে আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। আগের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করছি।

জানা গেছে ডা. তাজকেরা সুলতানা চট্টগ্রামের বাইরেও ঢাকা, খুলনা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় নারী ইউরোলজিস্টদের টিম গঠন করে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নারীদের এই রোগ থেকে মুক্তি দেওয়াকে তিনি আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন।

প্রস্রাব ঝরা রোগ সম্পর্কে প্রশ্ন থাকলে চট্টগ্রাম খবর-এর নির্দিষ্ট ইমেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে ডা. তাজকেরা সুলতানার পরামর্শ পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন এই মানবিক চিকিৎসক।

ডা. তাজকেরা সুলতানা চৌধুরীর নিকট প্রশ্ন পাঠানোর ই-মেইল: [email protected]

এসএ/এফএম

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।