মেজর সিনহা হত্যা– রায় পড়া শুরু

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল। সোমবার (৩১ জানুয়ারি দুপুর ২টায় তিনি এজলাসে বসে রায় পড়া শুরু করেন।

এর আগে কঠোর নিরাপত্তায় অভিযুক্ত প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকতসহ ১৫ আসামিকে কাঠগড়ায় হাজির করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে দুইটি মামলা দায়ের করে। মেজর সিনহা ও তার সঙ্গীদের মাদক কারবারী সাজাতে চেষ্টা চালায় তৎকালীন ওসি প্রদীপ। টেকনাফ থানায় দায়ের করা দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।

এরপর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা দায়ের করেন। বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরির্দশক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট মামলার তদন্তভার নেয় র‌্যাব। ওইদিন বিকেলে মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ১১ আগস্ট পুলিশের দায়ের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এপিবিএন-এর তিন সদস্য সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব। ১৪ সেপ্টেম্বর কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব। যে আসামিকে র‌্যাব যখনই গ্রেপ্তার করেছে তাদের আদালতে সোপর্দের সাথে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদনও করেছিল একসাথে।

কারাগারে থাকা ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। অপর ১২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি যুক্তিতর্কের শেষ দিন আদালতে কেঁদে কেঁদে প্রদীয় সিনহা হত্যার জন্য লিয়াকতকে দায়ী করেছেন। তখন আদালত তার জবানবন্দির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একইদিন পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সেইসঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত।

এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ-এর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ জুন পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওইদিনই তাকে কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ দেন। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন।

২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। সবশেষ ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে (৩১ জানুয়ারি) আদালত মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

সিনহা হত্যারপর একে একে প্রকাশ হতে থাকে প্রদীপসহ কক্সবাজার পুলিশের বিভিন্ন অপরাধ। প্রদীপের বিরুদ্ধে ১৪৪ জনকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। পুলিশ সদরদপ্তর কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে জেলা সব পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।