শ্বশুরবাড়ির ইফতারি-কাপড়ের নামে ‘উপহারসামগ্রী’ বন্ধ হোক

কয়েকদিন আগে ফেসবুক চালাতে চালাতে হঠাৎ একটি ভিডিও চোখের সামনে এসে পড়ে। সেখানে চিত্রটা এমন ছিলো যে—‘একজন মধ্যবয়সী বাবা মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে রোজার আগেই ইফতারির সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। কোন কারণে শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাঠানো ওইসব সামগ্রীতে সন্তুষ্ট হোননি। আর তাই সেসব পণ্য ফেলে দিয়েছেন পাশের কোন খাদে। সেই খবর বাবার কানে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর্তনাদ করতে করতে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এ চিত্র আসলে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এদেশের অনেক বাবা আছেন যারা এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। শুধু বাবা নয় মেয়েরাও শ্বশুর বাড়িতে শুনেন নানা রকম ‘খোঁটা’। যা পারিবারিক ও সামাজীক জীবনে যেমন অশান্তি তৈরি করে তেমনি নষ্ট করে সম্পর্ক। মেয়ের বিয়ে যেন বাবা-মায়ের জন্য হয়ে যায় ‘অপূরণীয় দেনা’!

বিশেষ করে দেশের সিলেট এবং চট্টগ্রামে এসব উপহার সামগ্রীর প্রচলন বেশি। একটা সময় বিয়েতে যৌতুক দেওয়ার প্রচলন ছিলো, যৌতুকের জন্য বিয়ে ভঙ্গ, দাম্পত্য জীবনে কলহ পুরাতন ঘটনা। মানুষের সচেতনতা এবং শিক্ষার হারের কারণে যৌতুক দিন দিন কমলেও যৌতুকের ‘আধুনিক রূপ’ এসব ‘উপহারসামগ্রী’র প্রচলন দিন দিন বাড়ছে। একটা মেয়েকে যখন বিয়ে দেওয়া হয় তার পরবর্তী বছর রমজান আসলে বাবার বাড়ি থেকে দিতে হয় ইফতারি। ইফতারির পর ঈদ আসলে শুরু হয় সেমাইসহ যাবতীয় জিনিস। এসব পণ্য ছাড়াও মেয়ের স্বামীর বাড়ির পরিবারের সকল সদস্যেদের জন্য দিতে হয় নতুন জামা-কাপড়।

ধনী পরিবারগুলোর কাছে এসব সামগ্রী ‘উপহার’ হিসেবে পরিচিত হলেও অধিকাংশ মধ্যভিত্ত-নিম্নভিত্তের কাছে এসব ‘বোঝা’ ছাড়া আর কিছুই না। যেখানে একজন বাবাকে নিজের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে আবার এক মাসের মধ্যে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে হয় ৩ ধরণের জিনিস। কেউ কেউ বলেন-‘এসব জিনিস তো বাধ্যতামূলক নয়, খুশি করে দেওয়া হয়’! বাস্তবে এই ‘খুশি’ করার জিনিস না দিলে মেয়েকে যেমন প্রতিনিয়ন ‘কথা’ শুনতে হয় তেমনি ‘অপমানিত’ হতে হয় মেয়ের বাবা-ভাইদের।

বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারদরে একজন বাবা যে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন শুধু তা নয় রীতিমতো খরচ যোগাতে পারছেন না। আর এমন পরিস্থিতিতে তিনি যদি মেয়ের বিয়ে দেন তাহলে তো মস্ত বড় বিপদ। ধার হোক বা দেনা হোক এসব সামগ্রী দিতেই হবে। এমনও ঘটনা আছে-নিজের পরিবার চলছে না। দীর্ঘদিনে অসুস্থতার চিকিৎসা হচ্ছে না। কিন্তু মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ‘জিনিস’ পাঠানোর জন্য মানুষ থেকে গিয়ে গিয়ে টাকা তুলতে হচ্ছে। আর শ্বশুর বাড়ির লোকজন সেসব জিনিস নিয়ে ‘খাচ্ছে-বিলাচ্ছে’।

আর যদি মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে চাহিদামতো ইফতার সামগ্রী বা কাপড় না পেলে মেয়েকে কটু কথা বা গালমন্দ শুনতে হয়। শুধু গালমন্দ নয় কোন কোন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয় যে মেয়েকে মারধরও করা হয়। মেয়ের বাবা-মা’সহ পরিবারের সদস্যদের করা হয় অপমান-অপদস্ত। আস্তে আস্তে সম্পর্ক খারাপ হতে হতে একটা সময় ঘটে আরও বড় দুর্ঘটনা।

রমজান কিংবা ঈদে এসব উপহারসামগ্রীর নামে যেসব জিনিস দিতে হয় সেটাকে যৌতুক না বলা হলেও এটি যৌতুক থেকে ভয়াবহ। এতে একদিকে যেমন খাবারের অপচয় বাড়ে অন্যদিকে সামাজিক অসাম্যের রেশও দেখা দিতে পারে। আমরা আজকাল ‘ইফতার পার্টি’ নিয়ে কথা বলছি। যে বিষয়টা সামাজিক সৌন্দর্য, পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে সেটা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি। অথচ ‘উপহারসামগ্রী’ নামের এই পণের বিষয়টি নিয়ে হয়তো ভাবছিও না।

আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছি এখনও হয়তো তাকিয়ে আছি শ্বশুরবাড়ির দিকে, কখন আসবে ইফতারি? কখন আসবে ঈদের জামা-কাপড়? আবার কেউ কেউ হাঁটতে গিয়ে বা দোকানে বসে আরেকজনকে প্রশ্ন করছি—তোর/আপনার শ্বশুর বাড়ি থেকে কি দিলো? আপনি যদি এমনটা না ভাবেন বা করেন তাহলে আপনার জন্য সাধুবাদ কিন্তু আপনি যদি এই কাতারে পড়ে যান তাহলে মনে রাখুন—‘আপনি যে উপহারসামগ্রী পেতে এতটাই ব্যাকুল তার জন্য হয়তো কোন বাবাকে রাতের পর রাত নির্ঘুম থাকতে হচ্ছে; কোন ভাইকে এদিক ওদিক হাত পাততে হচ্ছে; কোন মা নিজে কাপড় না কিনে আপনার চাহিদা মেটাচ্ছে। কারও কারও ঈদ আনন্দ আপনার জন্য বিষাদে পরিণত হচ্ছে।

আসুন যুগ যুগ ধরে চলে আসা শ্বশুরবাড়ির ইফতারি ও জামা-কাপড় নামক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে শান্তিতে থাকতে দেই। উপহারসামগ্রী নামক এই ‘জুলুমকে’ নিজে না বলুন অন্যকেও না বলতে সচেতনতা সৃষ্টি করুন। এমনটা হলে যেমন একজন বাবা প্রশান্তি পাবে তেমনি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েকেও ‘কটু’ কথা শুনতে হবে না। পরকালে আল্লাহর কাছ থেকেও মুক্তি মিলেবে।

অর্থনৈতিক লেনদেনের মৌলিক বিধান সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না এবং এই উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে মামলা কোরো না যে মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে গ্রাস করার গুনাহে লিপ্ত হবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)

আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমানের সম্পদ তার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া হস্তগত করলে তা হালাল হবে না।’ (বায়হাকি, হাদিস : ১৬৭৫৬)।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।