স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আনোয়ারায় অরক্ষিত সুরমা পুকুরপাড় বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার হলেও অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে চট্টগ্রামের আনোয়ারার বারশত ইউনিয়নের সুরমা পুকুরপাড় বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন উপজেলার ১২টি স্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৭১ সালের ৭ জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকার, আলবদরদের আক্রমন, পাল্টা আক্রমন হওয়ার পর পাক-বাহিনীসহ রাজাকার আলবদর বাহিনী একত্রে এ স্থানে শতাধিক নিরীহ লোককে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে নিয়ে আসে সুরমা পুকুরপাড় এলাকায়। এসময় নিহতের রক্তে সুরমা পুকুরের পানিও লাল হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

সময়টা ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বারশত ইউনিয়নের সুরমা পুকুরপাড়ে একটি চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিল অন্য সহযোদ্ধাদের জন্য। দোকানের বাইরে অদূরে অস্ত্র হাতে পাহারা ছিলেন রুস্তম আলী। তখন তাঁর বয়স ২১-২২ বছর। এসময় রাজাকারদের একটি দল ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু রুস্তম আলী অন্ধকারে ভুলবশত সহযোদ্ধাদের দল মনে করে টর্চের আলো জ্বেলে তাদের সংকেত দিতেই রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বুঝে ফেলে এবং রুস্তম আলীকে গুলি করে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা দোকান থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখতে পান রুস্তমের লাশ। সার্জেন্ট মহিউল আলমও এসে পৌঁছেছেন সেখানে। তারপর সুরমা পুকুরপাড়ে দাফন করা হয় তার লাশ।

রাজাকার কমান্ডার জালাল উদ্দিন ও গণি চৌধুরী কবর খুঁড়ে বের করে আনে রুস্তম আলীর লাশ। আর সেই লাশের গলায় দড়ি বেঁধে উল্লাস করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় মেরিন একাডেমির পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্পে। সুরমা পুকুর পাড় থেকে মেরিন একাডেমির পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পের দুরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। সড়কে কিছু পথ ইট বিছানো, কিছুটা মাটির। দীর্ঘ সড়কটিতে রুস্তম আলীর মৃতদেহের গলায় রশি বেঁধে উল্লাসে নিয়ে যাওয়ার সময় রক্ত-কাদায় একাকার হয়ে গিয়েছিল পুরো শরীর, খসে পড়েছিল রুস্তমের শরীরের মাংসও।

পাকিস্তাানি বাহিনীর মেজর এ দৃশ্য দেখে ভৎর্সনা করেছিল রাজাকারদের। পরে মৃতদেহের ওপর এ নির্মমতা প্রদর্শনের জন্য ধিক্কার জানিয়ে লাশটি আবার একই স্থানে কবর দেওয়ার জন্য গণি চৌধুরী ও জালাল চৌধুরীকে নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানী মেজর। পরে তারা সুরমা পুকুরপাড়ে এনে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীকে কবর দেন।

এদিকে ২০১২ সালে জেলা প্রশাসক বারশতের সুরমা পুকুর পাড়ে রুস্তম আলীর কবরটি পাকা করে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেন। কিন্তু সেটিও এখন অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। নির্মিত স্মৃতিসৌধে সন্ধ্যা হলে বসে নানা লোকের আড্ডা। শুধু সুরমা পুকুরপাড়ে নয়, শতশত নিরীহ লোককে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে গণকবর দেয়া কবর গুলোর অধিকাংশই পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সেখানে তৈরী হয়েছে ময়লার স্তুপ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ বলেন, ‘আমরা সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে ৫টি গ্রুপ এ অপারেশনে অংশ নিয়েছিলাম। গ্রুপ লিডার ছিলো কাজী আবদুল হক। ওইদিন বৃহস্পতিবার রাতে রুস্তম আলী শহীদের পর আমরা পুকুরের পূর্ব পাশের বাড়ী থেকে লোকজনের সহায়তা নিয়ে জানাজা নামাজ পড়ে কবর দিই। পরেরদিন রুস্তমকে কবর থেকে তুলে জালাল উদ্দিন চৌধুরী ও গণি চৌধুরী তার বুকে আরেকটি গুলি করে। ওই গুলির স্থানটিতে মাটিতে একটি বড় গর্ত হয়ে ছিল। রুস্তম আলীর বাড়ি উপজেলার হাইলধর ইউনিয়নের পীরখাইন গ্রামে।’

জানা গেছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে আনোয়ারার ১২ স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে ৪ শতাধিক মানুষ লোক শহীদ হয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে বারশত সুরমা পুকুরপাড়, বারশত ইউনিয়নের রাঙ্গাদিয়া ১৫নং ফেরিঘাট, দক্ষিণ বন্দর, বরুমচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন, বটতলী রুস্তম হাট, আনোয়ারা থানা, আনোয়ারা জয়কালী বাজারের ভরা দিঘীরপাড়, খিলাপাড়া, বারখাইন তৈলারদ্বীপ আওয়ামীলীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের বাড়ী, বারখাইন শঙ্খ নদীর পাড়, পূর্ব বারখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গন, পরৈকোড়া উচ্চ বিদ্যালয় পুকুর পাড়।

আনোয়ারা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, ‘বধ্যভূমি গুলোর কয়েকটাতে স্মৃতিস্তম্ব তৈরী করা হলেও বাকি বধ্যভূমি এখনো অরক্ষিত। এসব বধ্যভূমি চিহ্নত করে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করার দাবী জানাচ্ছি’

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।