চসিক কাউন্সিলরদের বেহাত হওয়া আইডি-পাসওয়ার্ডে ৫ হাজার সনদ—গ্রেপ্তার ৪

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) আলোচিত ভুয়া জন্মসনদ ইস্যুর ঘটনা তদন্তে নেমে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষায়িত টিম কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ৪ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। তদন্তে উঠে এসেছে-জাতীয় সার্ভার হ্যাক নয়, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের আইডি, পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই জালিয়াত চক্র প্রায় পাঁচ হাজার জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে। আর নিজেদের আইডি-পাসওয়ার্ড থাকে প্রত্যেক ওয়ার্ডের জন্ম নিবন্ধন সহকারীর নিকট।

মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে সিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সনদ জালিয়াত চক্রের গ্রেপ্তার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ। এসময় অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আসিফ মহিউদ্দীন, সহকারী কমিশনার দেলোয়ার হোসেন, পরিদর্শক সঞ্জয় সিনহাসহ ইউনিটের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় তার কক্ষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধ ইস্যু করতে যাচাই-বাছাইয়ের কিছু বিষয় থাকে। সরকারি একটি প্রক্রিয়ায় জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। সেই নিয়ম ভেঙ্গে তারা অপরাধ করেছেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ও। তাই আমরা গুরুত্ব দিয়ে এই চক্রটিকে আইনের আওতায় এনেছি। আরও যারা আছে তাদের নিয়ে আমাদের টিম কাজ করছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, জন্মসনদ ইস্যুর ঘটনায় আটককৃত চক্রটিসহ আরও একাধিক গ্রুপ জালিয়াতি কার্যক্রম দীর্ঘদিন যাবৎ সক্রিয়। এ পর্যন্ত তারা ৫ হাজারেরও অধিক জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু ও বিতরণ করেছে। সারাদেশে সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের মতো এমন একাধিক জন্মসনদ জালিয়াত চক্রের সন্ধান আমরা পেয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘জন্ম নিবন্ধন সেবা’ ‘জন্মনিবন্ধন সংশোধন সেবা’ ‘জন্ম নিবন্ধন হেল্প সেন্টার’ ইত্যাদি নামে বেনামে গ্রুপ খুলে তাতে স্বল্প সময়ে ও স্বল্পমূল্যে জন্মসনদ প্রদানের পোস্ট করেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা।

আটক চক্রটি তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে জানিয়ে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আসিফ মহিউদ্দীন বলেন, আটক চারজনের একজন ১৬ বছরের কিশোর জহির আলম। করোনায় টিকা দিতে গিয়ে তার মায়ের জন্ম সনদে ভুল পায়। ফেসবুক গ্রুপের সহযোগিতায় সে তার মায়ের জন্ম নিবন্ধনের ভুল সংশোধন করে। পরে ফেসবুক ভিত্তিক এমন গ্রুপে জড়িয়েছে নিজেই। সাথে ছিল তার আপন দুলাভাই মোস্তাকিম।

তিনি আরও বলেন, যাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতো। তারা তথ্য দিলে আরেকজন জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করে পিডিএফ কপি দিতো। আমরা আড়ালে থাকা চক্রটিকে ধরার চেষ্টা করছি।

শালা-দুলাভাইয়ের সাথে অটক অপর দুই জন হলো দেলোয়ার হোসাইন সাইমন, আব্দুর রহমান আরিফ। তাদের দুইজনের কম্পিউটার সংক্রান্ত টাইপ, প্রিন্টের ব্যবসা রয়েছে।
এসময় তাদের কাছ থেকে সিপিইউ, ৩টি মনিটর, ১টি স্ক্যানার কাম প্রিন্টার, ১টি প্রিন্টার এবং ৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

পুলিশ জানায়, গত ৮ জানুয়ারি চসিকের ৩৮ নম্বর, ৯ জানুয়ারি ১৩নম্বর, ২১ জানুয়ারি ৪০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের সার্ভারে যথাক্রমে ৪০, ১০ এবং ৮৪টি ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। জন্মসনদ সহকারীরা সংশ্লিষ্ট থানাসমূহে সাধারণ ডায়েরি করলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগ ছায়া তদন্ত শুরু করে। তদন্তে জন্ম নিবন্ধন জালিয়াতি কার্যক্রমে একাধিক চক্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ৫টি ওয়ার্ডে হাতিয়ে নেয়া আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে মাত্র ১৫ দিনে চক্রটি ইস্যু করে ৫৪৭টি জন্মসনদ। যার ভেতর ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডেই ৪০৯টি ভুয়া নিবন্ধন হয়েছে। যাদের নামে এসব সনদ দেওয়া হয় তার ঠিকানা দেখানো হয়েছে জামালপুর, শরীয়তপুর, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চসিকের জন্মনিবন্ধন আইডি প্রথম বেহাত হয়। ওইদিন দেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের অফিসিয়াল সার্ভারের আপগ্রেডেশনের কাজ চলার সময় হ্যাক করে ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা, ৬ নম্বর চকবাজার এবং ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে ১২টি ছিল রোহিঙ্গার নামে। এ ঘটনায় পতেঙ্গা ও চকবাজার থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট জন্মনিবন্ধন সহকারীরা।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।