দুই সংস্থার টানাটানিতে অনিরাপদ সন্দ্বীপ যাত্রা

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। আর যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সাম্প্রতিককালে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে দ্বীপটি। এই দ্বীপটির প্রধান যাতায়াত রুট কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাটের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে জর্জরিত সন্দ্বীপের ৪ লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে দুই সংস্থার টানাটানিতে উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন হয়নি নৌ রুটটিতে। উপরন্তু চরম অসন্তোষ রয়েছে সন্দ্বীপের প্রায় ৪ লাখ মানুষের। সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন পদক্ষেপের কারণে এখনও অনিরাপদ সন্দ্বীপ যাত্রা।

জানা যায়, বর্তমানে সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম রুটে জেলা পরিষদের ৬টি ঘাট চালু রয়েছে। ২০১৩ সালের আগে কুমিরা গুপ্তছড়া ফেরীঘাট ইজারা দিত বিআইডব্লিউটিএ। ২০১৩ সালে এই ঘাট নিয়ে জেলা পরিষদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। জটিলতা নিরসনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের উদ্যোগে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ সন্দ্বীপ ও সীতাকুণ্ডের দুই সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লি­উটিএ কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লি­উটিএ এর মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ৬ বছরের জন্য কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট পরিচালনা করবে জেলা পরিষদ। জেলা পরিষদ টার্মিনাল ও গ্যাংওয়ে ব্যবহার করার বিনিময়ে বার্ষিক ৪০ লাখ টাকা বিআইডব্লি­উটিএকে দিবে। চুক্তিতে আরো শর্ত থাকে, ৩ বছর পর টাকার পরিমাণ বাড়তে পারে। সেই শর্ত অনুযায়ী পরবর্তী ৩ বছর জেলা পরিষদ বার্ষিক ৫৫ লাখ টাকা করে বিআইডব্লি­উটিএকে দিয়েছে। দুই সংস্থার টানাটানিতে অনিরাপদ সন্দ্বীপ যাত্রা 1

সরকারি দুই সংস্থার চুক্তির মধ্যে ছিল চুক্তির মেয়াদ হবে ছয় বছর, যা জেলা পরিষদ পরিচালনা করবে। সে হিসাবে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর ছয় বছরের সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন ঘাট/পয়েন্ট পরিচালনা নিয়ে নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএর মধ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ঘাট/পয়েন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও ইজারা প্রদান বিআইডব্লিউটিএর ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ কারণে কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ-টার্মিনাল জেটি ঘাট নিয়ে জেলা পরিষদের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক নবায়ন না করে বিআইডব্লিউটিএ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইজারা প্রদানের মাধ্যমে পরিচালনা করতে চাইছে। কিন্তু জেলা পরিষদ অনড় অবস্থানে থাকায় সন্দ্বীপের ঘাট নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না। দুই সরকারি সংস্থার দ্বন্দ্বের কারণে উভয় ঘাটে যুগোপযোগী কোনো উন্নয়নমূলক কাজ না হওয়ায় প্রাচীন আমলের মতোই দেশের সবচেয়ে অনিরাপদ নৌ-রুটে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে সন্দ্বীপের মানুষ।

জেলা পরিষদ ঘাট পরিচালনার অর্ধযুগে যাত্রীদের নিরাপদ নৌযান ও উঠা-নামার কষ্ট দূর করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে যাতায়াত দুর্ভোগ নিয়ে সন্দ্বীপবাসীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্দোলন করা হলেও এসব বিষয়ে বরাবরই উদাসীন ছিলেন তারা। এসব কারণে বিআইডব্লি­উটিএ’র অধীনে এই রুটে নৌ যাতায়াত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি আছে স্থানীয় পর্যায় থেকেও।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালক নয়নশীল বলেন, সন্দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিআইডব্লিউটিএ তিনটি জেটি নির্মাণ ছাড়াও বয়া স্থাপন করেছে। জেলা পরিষদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এ ঘাটটিকে দেশের অন্যতম নৌ-রুটে পরিণত করতে একাধিক মেগা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘাটের মালিকানা বিআইডব্লিউটিএর কাছে না এলে নিরাপদ ও আধুনিক নৌ-রুট বাস্তবায়নের কাজ অধরাই থেকে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে সন্দ্বীপ এসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মা ও শিশু হাসপাতালের ডেপুটি ডাইরেক্টর মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন বলেন, জেলা পরিষদ এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তারা সম্পূর্ণ বে-আইনিভাবে ঘাট দখল করেছে এবং যাত্রী পারাপারের জন্য ইজারা দিয়েছে। নদী বা সমুদ্র পথে যাত্রী পারাপারের তাদের আইনানুগ কোন অধিকার নাই। এজন্য সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থা হলো বিআইডব্লিউটিএ। জেলা পরিষদের বে-আইনিভাবে যাত্রী পারাপারের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ’র কমিশন এজেন্ট কতৃক হাইকোর্টে রীট মামলা করা হলে হাইকোর্ট বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু জেলা পরিষদ, ইজারাদার ও স্বার্থান্বেষী মহলের কুট কৌশলের কারণে জেলা পরিষদ এখনো ঘাটের নিয়ন্ত্রণ বহাল রেখেছে। তারা খাস কালেকশানের নামে ঘাট পরিচালনা করছে।

তিনি বলেন, জেলা পরিষদের কাছ থেকে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে হস্তান্তর করা। যাত্রী পারাপারের একমাত্র নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ব থাকবে বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন নৌ-রুটের মত এটি বেসরকারি ভাবে নৌ-যান পরিচালনার জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। এতে প্রতিযোগিতার কারনে যাত্রীরা ভালো সেবা পাবে।

সন্দ্বীপ এসোসিয়েশন চট্টগ্রামের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিরাপদ নৌ-পথের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করছে। তাদের সাথে একত্বতা ঘোষণা করা দরকার এবং তাদের সাথে দাবি আদায়ে শরিক হই। তাই নিরাপদ নৌ-পথের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

এমএফ

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।