বাংলাদেশ নামে পরিচিত এই জনপদের মানুষকে সুপ্রাচীনকাল থেকে নানা বৈরি পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং দেশি-বিদেশি শাসক-শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের জন্যে লড়াই করতে হয়েছে।
মোগল-বৃটিশ ও পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তাদের সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ মানবসভ্যতা বিকাশের ইতিহাসে এক অনন্যা গৌরবময় ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ২০ থেকে ৭০ প্রায় পাঁচ দশক পর্যন্ত এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে বিজাতীয় দখলদারদের উপনিবেশিক শাসন ও পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে নিজেদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের অপরিমেয় আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানি প্রায় উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা জাতিগত শোষণ নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষকেও প্রায় ২৪ বছর ধরে একটানা সংগ্রাম করতে হয়েছে। ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি করে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের শাসকগোষ্ঠী শুরুতেই আঘাত হানে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার জন্মগত অধিকারের ওপর। তারা আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় উর্দু ভাষাকে। যা প্রকৃতপক্ষে কোন জাতিগোষ্ঠীর একক ভাষাও নয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ৫২’র ফেব্রুয়ারিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর এবং নাম না জানা আরো অনেক শহীদের রক্তের পথ ধরে শুরু হয় আমাদের জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রাম। ৫৪’র নির্বাচন, ৫৮’র সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ৬২ থেকে ৬৪’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা দাবি, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছে যায় একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামের শেষ ধাপে।
১৯৭১ সালে ৯ মাসে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিণামে দুর্ধর্ষ ও অত্যাচারী পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী পরাজয় বরণ করে। মুক্তিযুদ্ধাদের সাহস, শৌর্য ও বীরত্ব এবং মুক্তিকামী অকুতোভয় সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির অটুট ঐক্য এবং দৃঢ় সংকল্পের সামনে পরাজিত হয় নিষ্ঠুর ও বর্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় স্বল্প সংখ্যক পদলেহী অনুচর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি দখলদাররা ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করে। তারা ৩০ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। আড়াই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হরণ করে। লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১ কোটি মানুষকে ভিটামাটি ছাড়া করে শরণার্থী হতে বাধ্য করে। এত কিছুর পরও তারা শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে অভাবিতপূর্ব গণরায় বঙ্গবন্ধুকে অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক ও জননেতার আসনে অধিষ্ঠিত করে। সামরিক জান্তা জানোয়ার ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা শুরু করলে বাঙালিরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে পূর্ববাংলা।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলে সারাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ডক শ্রমিক ও বন্দর কর্মচারীদের প্রতিদিনের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে সমগ্র বন্দর এলাকা ছিল উত্তাল। এর সাথে যুক্ত হয় হালিশহর, পতেঙ্গা এলাকার সর্বস্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এবং স্টিলমিল, ইস্টার্ন রিফাইনারি, ইস্টার্ন ক্যাবলস, জিইএম প্লান্ট, ড্রাইডক ও তেল কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী।
৭১ এর মার্চের সেই অভূতপূর্ব গণজাগরণের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া চক্র ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ধুয়া তুলে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার আড়ালে চলতে থাকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর গোপন যুদ্ধ প্রতিশ্রুতি। বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার নীলনকশার অংশ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্র আনা হতে থাকে। এরকম একটি অস্ত্রের চালান নিয়ে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক জাহাজ সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়ে। এই খবর চট্টগ্রাম এর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছলে তারা সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৪ মার্চ ৭১ চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে বিকেলে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সভা আয়োজনের দায়িত্ব প্রদান করা হয় কলোনির বাসিন্দা চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র নেতা শামসুদ্দিনকে (পরবর্তীকালে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা)। তিনি তার বন্ধু আ ক ম রইসুল হক বাহার (মুক্তিযোদ্ধা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা)। আব্দুস সাত্তার (মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা, জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত) এবং তারেক দিলুকে (সিইউএফএলের সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা) ডেকে নিয়ে কলোনির স্কুল মাঠে জনসভার প্রস্তুতি এবং হালিশহর এলাকায় মাইকে প্রচারের নির্দেশ দেন। দুপুরের পর থেকেই স্কুল মাঠ লোকে-লোকারণ্য। হালিশহর পতেঙ্গার ছাত্র, তরুণ এবং বন্দরে শ্রমিকদের গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় কানায় কানায় পূর্ণ জনসভাস্থল।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়ার সভাপতিত্বে সভা শুরু হলে নবনির্বাচিত এমএনএ এমএ মজিদসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জ্বালাময়ী ভাষায় ইয়াহিয়া জান্তার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান (বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রথম পাঠ করেন) বক্তব্য রাখতে উঠেন।
তিনি তার ভাষণে জানান, নিউমুরিং কলোনির পূর্বপাশে কর্ণফুলী নদীর ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা সোয়াত জাহাজে করে বাঙ্গালীদের হত্যা করার জন্য অস্ত্র আনা হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন আমরা সে অস্ত্র নামাতে দেব না। আমরা সোয়াত জাহাজ অবরোধ করব। মুহূর্তে জনসভার চেহারা পাল্টে যায়। বক্তৃতা শোনার ধৈর্য হারায় উত্তেজিত, বিক্ষুব্ধ জনতা। ঠিক সেই মুহুর্তে স্টিলমিল থেকে ৪/৫ হাজার শ্রমিকের (সকলের হাতে এক থেকে দেড় হাত লম্বা লোহার রড) একটি জঙ্গি মিছিল সভাস্থলে পৌঁছামাত্রই জনাব হান্নান সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
জনতার মিছিল ছুটে চলে ৩ নম্বর জেটি গেটের দিকে। সেখানে নেভি ফ্লিট ক্লাবে বন্দরের নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক কর্তৃপক্ষের দপ্তর। মিছিল যতই এগুতে থাকে ততই দুপাশের মানুষ তাতে সামিল হয় এবং মিছিলের কলেবর স্ফীত হতে থাকে। পোর্ট নর্থ কলোনি থেকেও একটি বিরাট মিছিল এসে মিছিলে শামিল হয়। উত্তেজিত জনতার গলা ফাটানো স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলা মিছিলটি তিন নম্বর গেটের সামনে পৌঁছলে নেভি প্লিট ক্লাব থেকে মিছিল লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা। নিরস্ত্র জনতার উপর আকস্মিক এই বর্বর হামলায় ২৩ জন শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় অসংখ্য।
পাকিস্তানি সেনাদের এ হামলা ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে সারা শহর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ পৃথক বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ অস্ত্র খালাস ঠেকাতে চট্টগ্রাম বন্দরের সোয়াত জাহাজ অবরোধ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালীদের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে প্রথম নিরস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। সোয়াত অবরোধের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ ঘটনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যান্য অবস্থানও মূর্ত হয়ে উঠে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়েই চট্টগ্রাম বন্দর নানাভাবে আলোচনায় উঠে আসে। অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ঢাকায় গণহত্যা শুরুর সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ পদগুলোতে কর্মরত অবাঙালি কর্মকর্তারা বেছে বেছে স্বাধীনতার সমর্থক বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। অসংখ্য বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্ণফুলী নদীর পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। বন্দর রিপাবলিক ক্লাবের পাশের খালপাড়, কলোনির পশ্চিম দিকে সি জি পি ওয়াই সবই ছিল এক একটা বধ্যভূমি।
বন্দরে চাকরিরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেকে তাদের বাসা এবং চাকরি ফেলে গ্রামে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। সোয়াত অবরোধের পর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে বিরাজমান অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সৃষ্ট এই ভয়াবহ ভীতিকর অবস্থার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বন্ধ ছিল না। শত্রুবাহিনীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের ওপর আচমকা হামলা, বন্দর এলাকার পেট্রোল পাম্প এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার সুইচ বোর্ড বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। এতে বন্দরের অবাঙালী প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে দুঃসাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক অভিযানও সংঘটিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরেই। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট ৩১ জন বাঙালি নৌ-কমান্ডো চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীতে নোঙ্গর করা ১১টি জাহাজ লিমপেট মাইন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেয়। নৌ কমান্ডোদের এই অভিযান সাহস ও শৌর্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা বিশ্বজুড়ে নৌযুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত কার্যকর ও শিক্ষণীয় রণকৌশল হিসেবে গণ্য হতে পারে।
অপারেশন জ্যাকপট নামে আখ্যায়িত নৌ কমান্ডোদের এই মরণজয়ী, দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ণ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল ২টি। প্রথমত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কর্ণফুলী নদীতে জাহাজগুলো ডুবিয়ে দিয়ে নদীর নাব্য বন্ধ করে দেয়া। যাতে করে পাকিস্থানীদের সামরিক-বেসামরিক সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আর কোনো বিদেশি জাহাজও চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে না পারে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে এক মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত সে বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের নৈতিক সমর্থন আদায় করা।
নৌ কমান্ডোদের অপারেশন জ্যাকপট হানাদার পাকিস্তানিদের মধ্যে ভয়ংকর আতংক সৃষ্টি করে এবং সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোতে এ অভিযানের সাফল্য ব্যাপক প্রচার পায়। অভিযানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোদের কোনো ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার করতে হয়নি। সে কারণে সামরিক বিশ্লেষণে এটাকে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ সফল অভিযান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শামিল হন। তাদেরকে অভিযানে যাবার আগে আত্মহুতি দেয়ার অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর দিতে হয়েছিল। অপারেশন জ্যাকপট নামকরণ এর পেছনেও রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। জ্যাক ফুড শব্দের বাংলা অর্থ জুয়া খেলার ঘুটি রাখার পাত্র। জীবন বাজি রাখা এ অভিযানের নাম সে কারণে অপারেশন জ্যাকপট।
চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মংলা সমুদ্রবন্দরের ১৫ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট এবং আশুগঞ্জ, নগরবাড়ী, খুলনা,বরিশাল, গোয়ালন্দ ঘাট, ফুলছড়ি ঘাট এবং আরিচা ঘাট নদী বন্দরগুলোতে পরবর্তী সময়ে নৌ কমান্ডোদের আরো অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমান্ডোদের এই অভিযান যুদ্ধকে এক নতুন ও উচ্চ মাত্রায় উন্নীত করে। চট্টগ্রাম বন্দর অপারেশন জ্যাকপটে নেতৃত্ব দেন নৌ কমান্ডো আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর কমোডর, বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত)।
ফ্রান্সে প্রশিক্ষণরত ডুবোজাহাজের অপর ৭ জন বাঙালি নৌ-সেনাকে নিয়ে ’৭১ এর ২৯ শে মার্চ পালিয়ে এসে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অন্যান্য নৌ কমান্ডোদের সংগ্রহ করা হয় ভারতের বিভিন্ন যুব ও প্রশিক্ষণ শিবির থেকে। আনুমানিক ৫৫০ জন কমান্ডো একাত্তরের নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ কমান্ডোদের অপারেশন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি নির্ধারক ও মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। অভিযান বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
এই পটভূমিতে বিচার করলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত অবস্থান ও রণনৈতিক গুরুত্ব প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অন্য সকলের অবদান ও অবস্থান মূল্যায়ন করার সময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকাও সম্যক বিবেচনায় নেয়া অত্যাবশ্যক।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আ. ক. ম. রইসুল হক বাহার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম’র সদস্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। লিখাটি ট্রাস্ট চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হলো।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।