নে, ‘জয়বাংলা’ দিয়ে গোসল কর!

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম গণহত্যা নাথপাড়া-আবদুপাড়ায়

২৫ মার্চের সেই কালরাত। ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও চলে নিরীহ বাঙালীর ওপর পাক হায়েনাদের অতর্কিত হামলা। হালিশহরস্থ ইপিআর তথা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ক্যাম্পে পশ্চিমা হায়েনারা শুরু করলো বাঙালী সৈনিক নিধন। বাঙালী সৈনিকরাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ‘যার যা ছিল তা নিয়ে প্রস্তুত ছিল’। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, চলে ৩০ মার্চ রাত পর্যন্ত। রাতের শেষভাগে ইপিআর সৈনিকরা ২জন, ৫ জন, ১০ জন এভাবে ভাগ হয়ে ক্যাম্প এলাকা ছেড়ে যুদ্ধের জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন।

৩১ মার্চ সকালে কিছু বাঙালী জোয়ান সংগঠিত হয়ে আবার প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। তারা আশ্রয় চান পাশ্ববর্তী নাথপাড়া আর আবদুপাড়ায়। দুইপাড়ার মানুষজন ইপিআর জোয়ানদের দেখে মনে সাহস পায়। তারাও শপথ নেয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে।
কিন্তু জোয়ানদের আশ্রয় দেয়া, তাদের সহায়তা করায় এই দুই পাড়ায় বসবাসকারীদের জীবনে কী সর্বনাশ ডেকে আনবে তা কাক-পক্ষীও টের পায়নি। চোখের পলকেই এক জীবন্ত নরকে পরিণত হয় নাথপাড়া-আবদুপাড়া। নিরবালা দেবীর কোল থেকে সন্তান কেড়ে নিয়ে ছেলের শরীর টুকরো করে মায়ের শরীরে রক্ত ঢেলে পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠে বলে- ‘বহুতো জয়বাংলা বলেছিস, নে, জয়বাংলা দিয়ে (ছেলের রক্ত দিয়ে) গোসল কর!’

হরিরঞ্জন নাথের ছেলে দুলালের ঘাড়ে কিরিচ দিয়ে কোপ দিল, শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েগেল মাথা! পুত্রের লাশের উপর পিতা আছড়ে পড়লে পুত্রের লাশের ওপরেই জবাই করা হয় পিতাকে! ভাইয়ের জন্য ভাই আর্তনাদ করতেই সেই ভাইকেও হত্যা করা হয় ভাই-ভাতিজার লাশের উপর। এমনি নির্মম ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল সেদিনের নাথপাড়া, আবদুপাড়াবাসী।

প্রত্যক্ষদর্শী কুঞ্ছবালার কাছ থেকে শোনা সেদিনের চিত্রটা ছিল এরকম-
‘দরজার পাশেই খুকু রাণীর বড় ভাই দুলালকে কিরিচ দিয়ে কোপ দিল বিহারিরা। দেহ থেকে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপর তাঁদের মা নিরবালা দেবীকে টেনে এনে এক অবাঙালী বলল- খুবতো জয় বাংলা জয় বাংলা করেছিস এবার ছেলের রক্ত দিয়ে গোসল কর…।’ এ দৃশ্য দেখে মূর্ছা গেল খুকু ও নিরবালা। তারা যাঁকে পেয়েছে তাঁকে কুপিয়েছে। একসময় তাঁদের আরেক ভাই বাদল নাথকে নিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়েছিল খুকু। শেষরক্ষা হয়নি। বোনের বুক থেকে বাদলকে টেনে এনে হত্যা করল। শুধু তাই নয়, খুকু রাণীর কাকিমার কাছ থেকে কোলের শিশুটি নিয়ে ছুঁড়ে মারল দূরে।

নে, ‘জয়বাংলা’ দিয়ে গোসল কর! 1
নাথপাড়া গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কুঞ্ছবালা

শহীদ হরিরঞ্জনের মেয়ে খুকু রানীর মুখেই শুনি সেদিনে ঘটনা!
আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। সকালবেলা দরজা ধাক্কানোর শব্দ। কে কে…? উত্তর এলো ‘আমরা ইপিআর সদস্য। আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ হয়েছে। আমাদের আশ্রয় দিন।’ অর্ধশতাধিক মুক্তিকামী ইপিআর সদস্যকে আশ্রয় দিল নাথপাড়াবাসি। ‘‘আশ্রয় নেওয়া ইপিআর সদস্যদের খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হলো। আমাদের ভাই-বাবারা তাঁদের আশ্বস্ত করলেন আমরা একসঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করব। সকাল ১০টার দিকে প্রচন্ড গোলাগুলি। আমরা পুকুরপাড়ের মন্দিরে আশ্রয় নিলাম। এরই মধ্যে বেলা একটার দিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে একদল লোক এসে দরজায় ধাক্কা দিল। আমরা ভেবেছিলাম তারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। কিন্তু তারা জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছিল আমাদের প্রতারিত করতে। পরে বুঝলাম এরা শত্রুপক্ষ।
“বাড়ির ভেতর ঢুকে তারা চালালো হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগসহ নারকীয় তান্ডব। আমার বাবা, ভাইদের লাশ দেখে আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি আমার চারপাশে লাশের স্তুপ। বামপাশে আগুন জ্বলছে। এক সময় বুঝলাম আগুনে আমার শরীরের একাংশ ঝলসে গেছে। আমি লাফ দিলাম সামনের পুকুরে। পুকুর থেকে উঠে পাশের আবদু পাড়ায় গেলাম। কেউ আমাকে চিনতেছিল না। পরিচয় দেয়ার পর ঘরে নিয়ে চিকিৎসা করালো।”
অব্যক্ত কথাও আছে। সম্ভ্রম হারানোর ক্ষত অর্ধ শতাব্দী বয়ে বেড়াচ্ছেন খুকু রাণী। অনেকবার এসব কাহিনি বলেছেন অনেককে। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি মাথা থেকে বাদ দিতে পারেননি সেই দুঃসহ দিনের কথা।

নে, ‘জয়বাংলা’ দিয়ে গোসল কর! 2
৭১’র পাশবিকতার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন খুকু রানী

মহান স্বাধীনতার জন্য স্বামী আর দুই সন্তানকে চোখের সামনে শহীদ হতে দেখা নিরবালা দেবী (খুকুর মা) ২০০৮ সালের মার্চের ২ তারিখ ডানা মেলে আকাশের পানে ছুটে গেলেন। সেদিন ঘাতকেরা তাঁর গর্ভজাত ছেলের রক্ত দিয়ে স্নান করাল তাঁকে, শত আকুতি সত্বেও চোখের সামনে কুচি কুচি করল তাঁর নাড়ী ছেঁড়া সন্তান দুলাল, বাদল আর স্বামী হরিরঞ্জন নাথসহ অনেক স্বজনকে। ৭১’র সেই বীভৎস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিরবালা দেবী চলে গেলেও রেখে গেছেন সেদিনের আরও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী।

শুধু নাথপাড়ায় নয়, ঘাতকরা সেদিন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাশের আবদু পাড়ায়ও। সেখানে আজগর আলী, ইসহাক, বাবুল হক, সিদ্দিক আহমদসহ অনেকেই শহীদ হয়েছেন খুনিদের হাতে। এই দুটি পাড়ায় সেই ৩১ মার্চ দুপুরে শতাধিক বাঙালী নিহত হলেও অনেকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে ইপিআর সদস্যদের পরিচয় জানা যায়নি।
সেদিন প্রাণ দেওয়া অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দার কী অপরাধ ছিল? তাঁরাতো চেয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ। তাঁরাতো স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিবেদিত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (পরে যেটা বিডিআর এবং বর্তমানে যে বাহিনীর বিজিবি নাম করণ হয়েছে) সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছিলেন কেবল।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও এই দুই পাড়ার কারোরই মেলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। অনেকে অনেক আশার বানী শুনিয়েছেন তাঁদের। উল্লেখ করার মতো কিছুই জুটেনি তাঁদের ভাগ্যে। তাঁরাতো অর্থ-কড়ি চান না। চান শুধু একটু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, একটু মর্যাদা।
তাঁদের প্রাপ্তি বলতে- শিল্পী ঢালী আল মামুনের ডিজাইনে, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট ও ড. অনুপম সেন, ডা. মাহফুজুর রহমান, সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান শওকত বাঙ্গালীদের সহায়তায় ২০০১ সালে নির্মিত একটি শহীদ বেদি। এ ছাড়া আর কিছুই পাননি তাঁরা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, নাথপাড়ার গণহত্যা অন্য গণহত্যার নির্মমতার বিচারে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমরা অনেক চেষ্টা করেও নাথপাড়া, আবদুপাড়াবাসীর জন্য কিছু করতে পারিনি। শেষ একটি শহীদ বেধী তৈরি করে দিয়েছি। সেটিও এখন অযত্ন অবহেলায় আছে।
তিনি আরও বলেন, যাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের এই যশ-খ্যাতি, অর্জন তাঁদের আত্মার অভিশাপে যদি এ অর্জন কোন দিন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে?

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক চট্টগ্রাম খবর

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।