খাগড়াছড়ির পাহাড়ে জুমের ধান কাটার উৎসব

১৬ লাখ কেজির রেকর্ড উৎপাদন

খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এ সময় যেন এক উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। পাহাড়ের ঢালে সারি সারি সোনালি ধান, আর তার মাঝখানে নারী-পুরুষদের ব্যস্ততা যেন ধানের সাথে মিশে গেছে। কাঁধে ঝুড়ি, হাতে কাঁচি বা কড়াই, কেউ ধান কাটছেন, কেউ ঝুড়িতে ভরে নিচ্ছেন ধানের শিষ। বাতাসে ভাসছে নতুন ধানের ম-ম গন্ধ।

জানা গেছে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, আলুটিলা, পানছড়ির মরাটিলা এবং সদর উপজেলার গাছবান এলাকার জুমে এই দৃশ্য এখন সাধারণ। পাহাড়ি নারীরা ধান কেটে জুমঘরে (পাহাড়ি জমির বিশেষ ঘর) এনে রাখছেন। পুরুষেরা এই ধান গোলায় তুলছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর খাগড়াছড়ির জুমে ধানের উৎপাদন ১৬ লাখ কেজির বেশি হয়েছে।

চাষি অনিল ত্রিপুরা বলেন, এ বছর দুই একরের একটি পাহাড়ে জুমচাষ করেছি। অন্য বছরের তুলনায় বৃষ্টি কম হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে। তবে পাখি অনেক ধান নষ্ট করছে। এজন্য সব সময় ফসল পাহারায় রাখতে হচ্ছে।

জুমচাষ প্রায় অপ্রচলিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তারা পাহাড়ে আগাছা পরিষ্কার করেন। বৈশাখ মাসের শুরুতেই বৃষ্টি হলে বীজ বপন শুরু হয়। এরপর পাহাড়ের তুলনামূলক সমান জায়গায় ধান লাগানো হয়। পাশাপাশি কলা, মরিচ, হলুদ, আদা, বরবটি, বেগুন, শিম, মারফা, চিনাল, তিল, সাবারাং, ফুজি, লুমপোল (একধরনের মসলা), মিষ্টি কুমড়া ও বিভিন্ন শাকসবজি বপন করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে ধান পাকতে শুরু করে, আর ধান কাটা শেষ হলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ফসলও তোলা হয়।

দীঘিনালার চাষি প্রশান্ত ত্রিপুরা জানান, তার প্রায় তিন একর জুমের ধান ইতিমধ্যেই কাটা শুরু হয়েছে। দীর্ঘ আট মাসের পরিশ্রমের ফল এখন হাতে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, মৌসম অনুকূলে থাকায় সব ধরনের ফসলই ভালো হয়েছে। ধান ছাড়াও অন্যান্য পাহাড়ি ফসলের ফলনও ভালো হয়েছে।

গাছবান এলাকার কৃষক মঙ্গলময় চাকমা বলেন, গত বছর ধান তেমন ভালো হয়নি, তবে এবার ফলন ভালো হয়েছে। বিশেষ করে চিনাল এবং মারফার চাষে অনেকেই লাভবান হবেন।

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাছিরুল আলম বলেন, গত মৌসুমে জেলার ১,১২৪ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছিল। সেই সময় উৎপাদন ছিল ১,৫৪০ মেট্রিক টন, প্রায় ১৫.৫ লাখ কেজি। এবার ১৫০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হলেও ফলন ভালো হওয়ায় আশা করা হচ্ছে ১৬ লাখ কেজির বেশি উৎপাদন হবে।

জুমচাষের এই ব্যস্ততা শুধু ধান কেটে সংরক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। চাষিরা পাহাড়ের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজস্ব খাদ্য ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে। জুমঘর তৈরি করা হয় পাহাড়ে ফসল সংরক্ষণের জন্য। নারীরাও ঘরে বসে ধান বাছাই ও শুকানো কাজ চালাচ্ছেন, পুরুষেরা ধান গোলায় তুলছেন। পুরো পাহাড় যেন এক সোনালি সমুদ্রের মতো মনে হচ্ছে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি একসাথে কাজ করছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।